স্বপ্নের মেট্রোরেল এবার পাখা মেলল। লাখো মানুষের উৎসাহকে সঙ্গী করে গতকাল সকালে দিয়াবাড়ি থেকে মেট্রোরেলের হুইসেল বাজতে না বাজতেই উৎসুক মানুষরা ভিড় জমায়। এসময় ট্রেনের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে ডিএমটিসিএল’র কর্মীদের দেখা গেছে। পরীক্ষামূলকভাবে চালানো মেট্রোরেলের এই যাত্রার সঙ্গী হলেন- রাজধানীর হাজারো মানুষ। এ যেন স্বপ্ন জয়ের তৃপ্তিÑ যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশবাসীর বহুদিনের আকাক্সক্ষা। যদিও এটি ছিল প্রস্তুতিমূলক যাত্রা অর্থাৎ ট্রায়াল রান। তারপরেও দেশে প্রথমবারের মতো উড়াল পথে মেট্রোরেল চলছে সে দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতে চাননি রাজধানীবাসী। কেবল মেট্রোরেলের ট্রায়াল রান হিসেবেই বিষয়টিকে দেখছেন না দেশের মানুষ। এ ঘটনাকে দেশের উন্নয়নের অন্যতম মাইলফলক হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
উড়ালপথে চলন্ত মেট্রোরেল দেখার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে মেট্রোরেলের ট্রায়াল রান দেখতে আসা পল্লবীর রবিউল বলেন, ‘এতদিন ধরে দেখে আসছি ঢাকা শহরে মেট্রোরেলের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। এজন্য অনেক ভোগান্তি মেনে নিয়েছি। চরম যানজটে বিরক্ত হয়েছি। তারপরেও আশাÑ ঠিকই একদিন আমাদের মেট্রোরেল সব অপেক্ষার অবসান ঘটাবে। আজকে সেই দিন। সকাল থেকেই আমি প্রস্তুতি নিয়েছি। পরীক্ষামূলকভাবে মেট্রোরেল চলবে এই সংবাদ পেয়ে হাজির হয়েছি। চেয়েছি ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে। আমার সে আশা পূরণ হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে ঢাকাবাসীর সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কেবল ঢাকাবাসীর নয় সারা দেশের মানুষের প্রত্যাশা এভাবেই পূরণ করছেন জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
একই অনুভুতি জানালেন মিরপুরের মনিপুর থেকে আসা নুর গণি বিশ্বাস। পেশায় যিনি চিত্রশিল্পী। তিনি এসেছেন তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। নিজের আবেগ এভাবেই তিনি প্রকাশ করলেন ‘এতদিন দেখতাম কাজ না করেও সরকার মানুষকে বিভিন্ন ধরনের স্বপ্ন দেখাতে। শুভঙ্করের ফাঁকিতে পড়ে জনগণকে হতাশ হতে হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকারকে দেখলাম, কথায় নয় কাজে বিশ^াসী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তা করে দেখানোর চেষ্টা করেন। পদ্মাসেতু নির্মাণে তার অঙ্গীকার এবং তার বাস্তবায়ন যেমন দেখেছি, তেমনি মেট্রোরেল নিয়েও তিনি তার অঙ্গীকার পূরণ করেছেন। যা তাকে ইতিহাসের যুগ¯্রষ্টা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। আজ সত্যিই খুব ভালো লাগছে স্বপ্নের মেট্রোরেল এখন বাস্তব এবং দৃশ্যমান।’ আগামীকাল দেশের প্রথম মেট্রোরেলের ভায়াডাক্টের ওপর পরীক্ষামূলক চলাচল শুরুর দিন নির্ধারণ করে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। তবে তার আগে পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত দিয়াবাড়ি থেকে পল্লবী স্টেশন পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল করে।
প্রথমবারের মত স্বপ্নের মেট্টোরেল রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে শুরু করে মিরপুর পর্যন্ত ৬টি বগি নিয়ে চারটি স্টেশনে পরীক্ষামূলকভাবে কার্যক্রম চালিয়েছে। এদিন সকালে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো মেট্রোরেল এ রুটে চলাচল শুরু করলো বলে জানিয়েছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। আগামী বছর ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের উদ্বোধন হতে পারে বলে জানানো হয়।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, ডিপো থেকে শুরু করে যেসব স্টেশনের কাজ শেষ হয়েছে তাদের মধ্যে ট্রেনটি আগামীকাল রোববার আবার পরিচালনা করা হবে। তবে ঠিক কোন পর্যন্ত ট্রেনটি পরিচালনা করা হবে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। বর্তমানে মেট্রো রেলের লাইনে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। এসব পরীক্ষার ভিত্তিতে কতটুকু লাইনে ট্রেন পরিচালনা করা হবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আগামীকাল রোববার সকালে। এছাড়া করোনার মধ্যেও মেট্রোরেলের কাজ পুরোদমে চলছে। ইতিমধ্যে জাপান থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ৬টি কোচবিশিষ্ট চারটি ট্রেন দেশে পৌঁছেছে। এছাড়া আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে আরও ৫টি সেট ট্রেন আসবে। বর্তমানে কাজের অগ্রগতি ৬৮ শতাংশ।
প্রকল্প সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর এমআরটি-১ এবং এমআরটি-৫ নামক লাইন দুটির নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে এমআরটি-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার ও এমআরটি-৫ লাইন নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মোট ৩১.২৪ কিলোমিটার পথে কাজ শুরু হয়। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, মেট্রোরেল পুরো প্রকল্পে গত ৩০ জুন পর্যন্ত মেট্রোরেল-৬ প্রকল্পে সার্বিক অগ্রগতি ৬৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত এই মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে। এর দৈর্ঘ্য ২১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশ চলতি বছরের ডিসেম্বরে এবং এছাড়া আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত আগামী বছর জুনে এবং কমলাপুর পর্যন্ত পুরো অংশ ২০২৪ সালের মধ্যে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু করোনা মাহামারি এই লকডাউনের কারণে কাজের গতি অনেকটা কমে গেছে। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক বলেন,‘ ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে লকডাউনের কারণে প্রকল্পের কাজ কিছুটা কম হয়েছিল। তবে এখন থেকে আবার দ্রুতগতি কাজ শুরু হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। টার্গেট নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি ঠিকই। এখানে বড় সমস্যা বিদেশি জনবল। জাপানি কনসালট্যান্ট যারা আছেন, মহামারির কারণে তারা স্বাস্থ্যবিধি ও নিয়মকানুন মেনে চলেন। অনেক পণ্য আছে যেগুলো বিদেশ থেকে আনতে হয়। এসব ইক্যুইপমেন্ট সরেজমিনে দেখতে হয়। কিন্তু এই সময়ে বিদেশি কনসালট্যান্টরা সরেজমিনে থাকতে না পারায় দেরি হচ্ছে। আবার ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ ও বিদেশি জনবল দেশে আসতে সংশ্লিষ্ট দেশের এমবার্গোর সমস্যাও রয়েছে।’ গত জুন মাসের প্রকল্প অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছেÑ মেট্রোরেল-৬ প্রকল্পটি ৮টি প্যাকেজে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ডিপোর ভূমি উন্নয়ন প্যাকেজ-১ এর কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে ২০১৮ সালে জানুয়ারিতে। প্যাকেজ-২ এর ডিপো এলাকার পূর্ত কাজ ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্যাকেজ-৩ ও ৪ নম্বরে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেলপথ ও ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ অংশের অগ্রগতি ৮২ দশমিক ১৭ শতাংশ। ৫ নম্বর প্যাকেজে আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ৩ দশমিক ১৯৫ কিলোমিটা রেলপথ ও ৩টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এই অংশের অগ্রগতি ৭০ দশমিক ৩ শতাংশ। ৬ নম্বর প্যাকেজে কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল ৪ দশমিক ৯২২ শতাংশ রেলপথ ও ৪টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এই অংশের অগ্রগতি ৭০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ৭ নম্বর প্যাকেজে প্রকল্পটির ইলেক্ট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম সরবরাহ ও নির্মাণ করা হচ্ছে। এ কাজের অগ্রগতি ৭২ শতাংশ। ৮ নম্বর প্যাকেজে রেলকোচ ও ডিপো ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহের কাজের অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। ইতোমধ্যেই মেট্রোরেলের প্রথম ও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সেট ঢাকায় পৌঁছেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতির পিতার লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়তে আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছে দেশ। পদ্মা সেতু ও অন্যান্য প্রজেক্ট বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হওয়া ছাড়াও উন্নয়নের সকল সূচকে বাংলাদেশের অর্জন ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। মাথাপিছু আয় বাড়ছে। বাড়ছে গড় আয়ু। অর্থনীতির আকার বাড়ছে। বেড়েছে বাজেটের আকার। একই সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়নে পরনির্ভরতাও কমছে। অবকঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে। বড় আকারের প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সক্ষমতাও বাড়ছে। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। নিজেদের আকাশে স্যাটেলাইট হয়েছে। বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে। কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। তথ্য প্রযুক্তি খাতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এমন উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় উঠে আসায় বিশ^জুড়ে আরোচনার জন্ম দিয়েছে। মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে কীভাবে বাংলাদেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতার সক্ষমতা অর্জন বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দূরত্বে। এসব প্রকল্প চালু হলেই দেশের অর্থনীতি আরো কয়েকধাপ এগিয়ে যাবে যা অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।