সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে স্বল্প থেকে মাঝারি আকারের বন্যার শঙ্কা প্রকাশ করছে আবহাওয়া অধিদফতর। উজানে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে দেশের ৬টি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে। বিশেষ করে টাঙ্গাইল, পাবনা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী ও শরীয়তপুরের নিম্নাঞ্চলের বন্যা শঙ্কার কথা জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। এদিকে দেশের নদ-নদীর মধ্যে ১০৯টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৭টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদফতর পূর্বাভাস দিচ্ছে, আগামী দুই সপ্তাহ উজানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এদিকে বৃষ্টির কারণে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা অববাহিকায় নিম্নাঞ্চল এরই মধ্যে তলিয়ে গেছে।
তবে উত্তরাঞ্চলে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে রংপুরের রাজারহাটে ৯৩ মিলিমিটার।
আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান খান জানান, মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে। আগামী দুদিন বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। আবহাওয়া অধিদফতরের আগামী দুই সপ্তাহের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, উজানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, আগস্টের শেষ সপ্তাহে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি বৃদ্ধির প্রবণতা থাকলে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট কিছু জেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
উত্তরাঞ্চলে লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী ও কুড়িগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি এই বন্যা দেখা দিতে পারে। যমুনার পানি বাড়লে মধ্যাঞ্চলে পদ্মার পানিও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর ও মাদারীপুরের নিম্নাঞ্চলেও বন্যার বিস্তার ঘটতে পারে। গতকাল শুক্রবার টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মহেড়া ইউনিয়নের কদিমধল্যা-ছাওয়ালী-বাসাইল সড়কের পূর্বপাশে ভাতকুড়া ও আদাবাড়ী এলাকা সূত্র জানায়, সমতল ভূমি পানিতে ডুবে গেছে। চলতি ভরা বর্ষা মৌসুমে মাত্র ১৫ দিন আগেও ওইসব এলাকায় আবাদি জমিতে পানি না আসায় কৃষক চিন্তিত ছিলেন। কারণ, আবাদি জমিতে বর্ষা মৌসুমে পানি না আসলে জমির উর্বরতা কমে। ওই সময় বাড়তি লাভের আশায় তারা জমিতে রোপা আমন বোনেন।
মির্জাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মশিউর রহমান জানান, মির্জাপুরে এ বছর ৫ হাজার ৫ হেক্টর জমিতে রোপা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। পানি না আসার কারণে কৃষকদের রোপা আমন বোনার উৎসাহ দেখে মনে হয়েছিল, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি অর্জন হবে। এখনও সেই প্রত্যাশা রয়েছে। তবে হঠাৎ বন্যার পানির কারণে মহেড়া ইউনিয়নের ভাতকুড়া, আদাবাড়ীসহ আশপাশের এলাকা, বহুরিয়া ইউনিয়নের গবড়, বহুরিয়া এলাকাসহ মির্জাপুরের বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৯ হেক্টর রোপা আমন ধান পানিতে ডুবে গেছে। তবে পানি ১০-১২ দিনের মধ্যে সরে গেলে ধানের তেমন ক্ষতি হবে না বলে সংশ্লিস্ট কৃষি কর্মকর্তারা জানান।
এদিকে উত্তারাঞ্চলের পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলগুলোর অবস্থা বন্যায় নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে খাগড়াছড়িতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে পাহাড়ধস। এর মধ্যে শালবন ও কলাবাগান এলাকায় বসতঘরের পাশে পাহাড়ধস হয়েছে। তবে এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বন্যাকবলিত পরিবারগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে অনুরোধ করা হচ্ছে। সদরে পাঁচটা আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো হলো-মহালছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গঞ্জপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, গঞ্জপাড়া মাদরাসা, গোলাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ ও মুসলিমপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়।
সকালে খাগড়াছড়ি শহরের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, চেঙ্গী নদী, খাগড়াছড়ি ছড়া ও মধুপুর এলাকার ছড়ার পানি বেড়ে গিয়ে মুসলিমপাড়া, কালাডেবা, বটতলী, গঞ্জপাড়া, শব্দমিয়াপাড়া, ফুটবিল, এপিবিএন, মিলনপুর, খবংপুড়িয়াসহ কয়েকটি এলাকার বাড়িঘর ডুবে গেছে।
খাগড়াছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহফুজা মতিন বলেন, পানিবন্দি মানুষের জন্য রান্না করা খাবার, শুকনা খাবার আর বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১ হাজার ২০০ পরিবারের জন্য বর্তমানে ৫টা আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনে আশ্রয়কেন্দ্র বাড়ানো হবে। এ ছাড়া পানিবন্দি মানুষের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা হবে।
রাজশাহী আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, পদ্মার পানি বৃদ্ধিতে কোন চর তলিয়ে গেছে। আবার কোনটি জলমগ্ন। এমন অবস্থায় চরে গরু লালন-পালনকারীরা পড়েছেন বিপাকে। একদিকে গরুর থাকার জায়গার অভাব, অন্যদিকে খাবারের অভাব। সবমিলে উভয় সংকটে চর ছেড়ে লোকালয়ে এসেছেন আবু তাহের, শাজদার ও শাহাদুলেরা। তারা বলছেন, পদ্মার মধ্যচরে যারা বসবাস করেন, তারা পদ্মায় পানি বাড়ার শুরুতেই লোকালয়ে চলে এসেছেন। মধ্যচরে অল্প মানুষ ও গবাদি পশু ছিল। পদ্মার পানি বাড়ায় চারপাশ তলিয়ে গেছে। এছাড়া মধ্যচরেও পানি উঠেছে। এমন অবস্থায় গরু নিয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই এক সপ্তাহ আগে গরুগুলো নিয়ে লোকালয়ে চলে এসেছেন তারা। তারা আরও বলছেন, পানি নেমে গেলে আবারও গরুগুলো নিয়ে পদ্মার চরে ফিরে যাবেন তারা। গত বুধবার বিকেলে নগরের বিনোদপুরের রেডিও সেন্টার মাঠে চরের গরুগুলো ও রাখালদের ২৩০টি গরু চড়াতে নিয়ে আসেন। শাজদার আলী নামে একজন জানান, ‘গরুগুলো থাকতো পদ্মার মধ্যচরে। বর্তমানে সেখানটা জলমগ্ন। তাই এক সপ্তাহ আগে ২৩০টি গরু নৌকায় তুলে লোকালয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এপারে (লোকালয়ে) গরুর থাকা ও খাবারের সংকট। উপায় নেই। তবুও নিয়ে আসতে হয়েছে।’
কুড়িগ্রাম বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, কুড়িগ্রামে ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয় দফা পানি বৃদ্ধি পেয়ে ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপূত্র নদের পানি চিলমারি পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার নিচে অবস্থান করছে। কমছে তিস্তার পানি। তিস্তা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে ৪২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডুবছে নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল। দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। বন্যায় প্রায় ৭ হাজার হেক্টর রোপা আমন ও শাক-সবজি তলিয়ে গেছে। ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপূত্র, দুধকুমর ও গঙ্গাধর নদীর ভাঙনে গত এক সপ্তাহে প্রায় দুই শতাধিক বাড়িঘর বিলিন হয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে নদীপাড়ের মানুষ।