মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অতিরিক্ত ফি আদায়সহ নানা অভিযোগের ভিত্তিতে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় নিউজ পোর্টাল বিবার্তা২৪ডটনেট-এর বিরুদ্ধে জিডি ও দেখে নেয়ার হুমকি দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যে সুনামক্ষুণ্নের চেষ্টা আখ্যা দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকদের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে কলেজ প্রশাসন।
রাজধানীর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের অনিয়মের বিরুদ্ধে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রকাশিত ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলোকে কলেজের সুনামক্ষুণ্নের চেষ্টা আখ্যা দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকদের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় একটা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে কলেজ প্রশাসন। যার জিডি নম্বর-১৪৬৬। থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ আগস্ট ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের পক্ষে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন কলেজের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল হাকিম।
জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১৭ আগস্ট বিবার্তার ৩ জন প্রতিবেদক কলেজে উপস্থিত হয়ে কলেজের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানা অপচেষ্টা চালায়। সেই সাথে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য ও হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে কলেজের সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা করছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার এসআই আলতাফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের পক্ষ থেকে একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। বিষয়টির সত্য-মিথ্যা যাছাই করা হচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে নানা অনিয়মের দায়ে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে রাজধানীর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউজ পোর্টাল বিবার্তা২৪ডটনেট। প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং অনিয়মের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় কলেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোর্ড। অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রথম দফায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজকে কড়াভাবে সতর্ক করে দেয়। কিন্তু এরপরও প্রতিষ্ঠানটি বোর্ডের নির্দেশ না মানায় দ্বিতীয় দফায় কলেজের প্রিন্সিপালকে বোর্ডে তলব করা হয়। সেখানে অনিয়মের বিষয়টি আমলে নিয়ে অভিযুক্ত কলেজটিকে বোর্ডের নির্দেশনা মানতে বাধ্য করা হয়।
ওই ঘটনার প্রেক্ষাপটে বিবার্তার সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকদের বিরুদ্ধে জিডি করা হয়। সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রতিবেদককে হয়রানী করার অভিযোগও রয়েছে।
এর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা উপেক্ষা করে স্পেশাল ক্লাসের নামে অতিরিক্ত ফি আদায়, শিক্ষার্থীদের সশরীরে কলেজে আসতে বাধ্য করা, ফরম পূরণের নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে গড়িমসিসহ বিস্তর অভিযোগ উঠে রাজধানীর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের বিরুদ্ধে। বোর্ডের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন আদেশ ও বিতর্কিত কার্যক্রমের কারনে অতিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এ নিয়ে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে গত ১৭ আগস্ট প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবার্তা। এ প্রতিবেদন করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছে অনলাইন এ গণমাধ্যমকে। কলেজ কর্তৃপক্ষ অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য না দিয়ে নানা টালবাহানার আশ্রয় নেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ।
শুধু তাই নয়, অভিযুক্ত কলেজটি অভিযোগের বিষয়টি আমলে না নিয়ে উল্টো শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ফি না দিলে পরীক্ষায় বসতে না দেয়ার হুমকিও দেয়। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৯ আগস্ট ধারাবাহিক ২য় প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবার্তা।
এ প্রতিবেদনের বিষয়ে কলেজের বক্তব্যের জন্য ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজে গেলে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরেও হয়রানির শিকার হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক। কলেজের দারোয়ান মো.আরিফ হোসেন তাকে কলেজে প্রবেশে বাধা দেন। এসময় দুই ঘণ্টার বেশি সময় তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এরপর প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল ও ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
কলেজের সাইনবোর্ডে থাকা নাম্বারে যোগাযোগ করলে একপর্যায়ে কল রিসিভ করে। এসময় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রসঙ্গে কলেজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে চাইলে ঐশ্বর্য চৌধুরী নামের একজন জানান, শনিবার (২১ আগস্ট) তারা অভিযোগের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিবেন।
তবে এর কিছুক্ষণ পরই কলেজের দাড়োয়ানের মাধ্যমে প্রতিবেদককে কলেজের প্রশাসনিক কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল একাডেমির সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. মজিবুর রহমান খোকন, কলেজের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. আবদুল হাকিম, ইংরেজি শিক্ষক মিল্টনসহ কয়েকজন।
মো. মজিবুর রহমান খোকন জানান, প্রতিটি বেসরকারি কলেজের নিজস্ব কিছু নীতিমালা থাকে, আমরা আমদের নিজস্ব নিয়ম মেনেই সব পরিচালনা করি।
এসময় প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশিত ফরম ফিলাপের শেষ সময় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ১৯ তারিখ ফরম ফিলাপের শেষ সময় হলে সমস্যা কি? শিক্ষা মন্ত্রণালয় দিয়ে তো আর অফিস চলে না। সময়মতো ফরম ফিলাপ কার্যক্রম শেষ করার জন্যই এধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
২য় ধারাবাহিক প্রতিবেদনের পরও লাগামহীন আচরণ করে যাচ্ছিল অভিযুক্ত এ কলেজ। এরপর সার্বিক অনিয়মের বিষয়ে বিবার্তা ৩য় ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে গত ২২ আগস্ট।
এ প্রতিবেদনের বক্তব্যের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুসারে ২১ আগস্ট সরেজমিনে কলেজে যান বিবার্তার সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক। এদিন একাধিকবার মুঠোফোন ও ক্ষুদেবার্তায় যোগাযোগ করার পর কলেজের প্রিন্সিপাল শিবলি সাদিক বিবার্তাকে যেন ক্ষমতাই জাহির করলেন। তিনি বলেন, আজকে আমরা এসব ব্যাপারে কোনো কথা বলব না। আমরা আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছি। আপনাদের যথাসময়ে জানানো হবে।
এদিকে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের নানা অনিয়ম ও অভিযোগের বিষয়টি নজরে আসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের। এরপর বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ অভিযোগের ভুক্তভূগী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হন। তিনি ওই সময় বিবার্তা প্রতিবেদককে বলেন, কোনো কলেজ শিক্ষা বোর্ডের নির্ধারিত ফি’র অতিরিক্ত ফি আদায় করলে কিংবা বোর্ডের নির্দেশনা না মানলে শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা বোর্ডে অভিযোগ করলে ওই কলেজের বিরুদ্ধে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অতিরিক্ত ফিসহ অনিয়ম দেখলেই শিক্ষার্থী-অভিভাবককে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে কলেজের প্যানেল বন্ধ করে দেয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে অতিরিক্ত ফিসহ অনিয়মের দায়ে ৫৩টি কলেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পরে অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেয়ায় তাদের প্যানেল খুলে দেয়া হয়েছে।
এরপর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের পরামর্শ অনুসারে সোমবার (২৩ আগস্ট) ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের ভুক্তভোগী বেশ কিছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোর্ডে গিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এসময় বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এসএম আমিরুল ইসলাম কলেজ প্রিন্সিপাল মো. শিবলি সাদিককে বোর্ডের পক্ষ থেকে ফোন দিয়ে মঙ্গলবারের (২৪ আগস্ট) মধ্যে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের বোর্ড নির্ধারিত এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ ফি ও টিউশন ফি ছাড়া বাবিসব ফি বাদ দিয়ে ফরম পূরণ করার কঠোর নির্দেশনা দেন। বোর্ডের এই নির্দেশনা অমান্য করলে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এই কলেজের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও সতর্ক করা হয়।
কিন্তু পরের দিন মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা বোর্ড নির্দেশনা অনুযায়ী কলেজে ফরম পূরণ করতে গেলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের অতিরিক্ত ফি না কমিয়ে উল্টো হুমকি দিতে শুরু করে। এমনকি এদিন কলেজের আশপাশে পুলিশ রেখে শিক্ষার্থীদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হয়, থানায় নিয়ে যাওয়ার হুমকিও দেয়া হয়।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা বোর্ডে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানালে সংশ্লিষ্টরা শিক্ষার্থীরা বোর্ডে গিয়ে অভিযুক্তদের নির্দেশনা দেয়। বোর্ডকে বিষয়ে অবগত করলে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এসএম আমিরুল ইসলাম ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের প্রিন্সিপাল মো. শিবলি সাদিককে বোর্ডে তলব করেন। পরে ওই দিন বিকেলে কলেজ প্রিন্সিপাল নিজে প্রতিনিধি দল নিয়ে বোর্ডে উপস্থিত হন। এরপর দুই পক্ষের অভিযোগ শুনে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আমিরুল ইসলাম কলেজ প্রিন্সিপাল শিবলি সাদিকে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের বোর্ড নির্দেশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ ফি ও টিউশন ফি ছাড়া বাকি সব ফি বাদ দিয়ে যেনো ফরম পূরণ করার ব্যবস্থা করা হয়, এমন নির্দেশ দেন।
বিষয়টির ব্যতয় হলে ইতোমধ্যে অনিয়মের দায়ে ৫৩টি কলেজের প্যানেল বন্ধ করা হয়েছে উল্লেখ্য করে জানিয়ে দেন অনিয়ম করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
এসময় শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, তোমাদের পরীক্ষা কেউ আটকাতে পারবে না। যেহেতু তোমাদের রেজিস্ট্রেশন আছে, তোমরা অবশ্যই পরীক্ষা দিতে পারবে। অ্যাডমিট কার্ড তো যাবে আমার সাক্ষরে। প্রয়োজনে তোমাদের অন্য কলেজ থেকে ফরম পূরণের ব্যবস্থা করা হবে। তোমাদের কলেজ অনিয়ম করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এসময় উপস্থিত এক শিক্ষার্থী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে বলেন, স্যার, কলেজ আমাদের হুমকি দিলে কি হবে? তখন তিনি বলেন, কেউ তোমাদের কিছু করতে পারবে না। বোর্ড শিক্ষার্থীদের পাশে আছে। অন্যায় করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
এসময় আরেক শিক্ষার্থী বলেন, স্যার আমরা যারা ইতোমধ্যে অতিরিক্ত ফি দিয়েছি তাদের কি হবে? তখন তিনি বলেন, তোমরা কলেজে যাও। সবকিছু নিয়ম মেনে হবে।
শিক্ষা বোর্ডের সরাসরি তলবকৃত এ নির্দেশনার পরের দিন ২৫ আগস্ট (বুধবার) শিক্ষার্থীরা কলেজে গেলে তাদের মধ্যে যারা আগে ফরম ফিলাপ করেনি তাদের নির্ধারিত ফি অনুসারে ফরম ফিলাপ করা হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে যাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায় করা হয়েছে তাদেরকে কলেজ নোটিশ দিয়ে অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে কলেজে উপস্থিত একাধিক শিক্ষার্থী বিবার্তাকে বলেন, যারা আগে ফরম ফিলাপ করেনি তাদের থেকে বোর্ড নির্দেশনা মেনে টাকা নেয়া হচ্ছে এখন। আর যারা আগে অতিরিক্ত ফি দিয়েছে তাদের দুজনকে ইতোমধ্যে টাকা ফেরত দিয়েছে। বাকিদেরও কলেজ নোটিশ দিয়ে অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
বিবার্তার সংবাদের কারণে শিক্ষার্থীদের অভিযোগগুলোর নিষ্পত্তি হওয়ায় শিক্ষা বোর্ডকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বিবার্তার অফিসে এসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।