#বিস্তর অভিযোগ চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে। #ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন, বিতর্কিতদের পদায়ন, পদ বাণিজ্য নিয়ে বিভক্তি নেতাদের মধ্যে।
এরশাদের হাতে গড়া জাতীয় পার্টি আবারও ভাঙনের কবলে পড়েছে। সংসদের প্রধান বিরোধী দলের এই অচলাবস্থা দেশের রাজনীতিতে নানা গুঞ্জনের জন্ম দিচ্ছে। রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় সব ধরনের সরকারি সুবিধা নিয়ে ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি গঠন করেন সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরবর্তী সময়ে এরশাদের জীবদ্দশাতেই কয়েক দফা ভাঙনের কবলে পড়ে দলটি। বর্তমানে দলটি ৪ ভাগে বিভক্ত। এর একটি ভাগের নেতৃত্ব দিতেন এরশাদ নিজেই। সে অংশটির নেতৃত্বে রয়েছেন তার ভাই জিএম কাদের। অন্য তিন অংশের নেতৃত্বে আছেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর (জেবি), আন্দালিব রহমান পার্থ (জাপা, নাজিউর রহমান মঞ্জু) ও কাজী জাফর আহমেদ (প্রয়াত)। ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে জাতীয় পার্টির তিনটি অংশ পরিচালিত হলেও জিএম কাদের নেতৃত্বাধীন অংশ মূল দল বলে দাবি করা হচ্ছে। সংসদেও এদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। চলমান সংসদে এরাই বিরোধী দলের আসন অলংকৃত করছেন। ত্যাগী কর্মীরা এই ভাঙনের দায় চাপিয়েছে দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের উপর। তাদের দাবি, তার একগুয়েমিতা, পদব্যাণিজ্য এবং যোগ্যদের অবমূল্যায়নের কারণেই দলটির ভাঙনের ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই মারা যাওয়ার পর থেকেই দলটিতে নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দেয়। কে দলের হাল ধরবেন এই প্রশ্নে দলটিতে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরশাদপত্নী রওশন নাকি ভাই কাদের হবেন দলের চেয়ারপারসনÑতা নিয়ে এরশাদের মৃত্যুর পর পরই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। পরে সমঝোতার মাধ্যমে সে অচলাবস্থা নিরসন হয়। দলের চেয়ারপারসন হিসাবে এরশাদের ভাই জিএম কাদের এবং সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হিসাবে রওশনকে মনোনীত করা হয়। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করা গেলেও পরবর্তীতে সে সমাঝোতায়ও ফাটল ধরে। গত কয়েকদিন ধরে ফের দলটিতে ভাঙনের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি এরশাদপুত্র এরিক এরশাদ চাচা কাদেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে নিজের পছন্দমত কমিটির ঘোষণা দেন।
এ বিষয়ে দলটির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু ভোরের পাতাকে বলেন, ‘দেশে বড় দল তিনটি। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপি। এখন কোনো দলের কার্যালয়ে লোক বা কর্মীদের দেখা যায়? কর্মীরা জানেন না দলের কোনো কাজ হচ্ছে কিনা, কিভাবে দল চলছে। দলগুলোর সব কাজ এখন মিডিয়ায় আছে বাস্তবে নেই। এরপরও আমরা কিছুটা হলেও মাঠে থাকার চেষ্টা করছি। সেইসঙ্গে কর্মীবান্ধব হয়ে চলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘মহামারি করোনার কারণে কোন দলই তাদের স্বাভাবিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারছে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তো মাঠ গরম করা যায় না। সঙ্গতভাবেই পার্টি কার্যালয়ে চোখে পড়ার মত কর্মী উপস্থিত থাকেন না। যদিও দেবর-ভাবীর কোন্দলের মধ্যেও পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দুজনকে একত্রে দেখা গেছে।
এদিকে মহাসচিবের বক্তব্য নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব সাঈদুর রহমান টেপা। তিনি বলেন, ‘দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের দলকে শক্তিশালী করার জন্য আটটি বিভাগে অতিরিক্ত মহাসচিবদের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। আগামী নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা।’ তিনি বলেন, ‘আল্লাহ চাইলে এবং জনগণের সমর্থন পেলেই আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।’
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির এক নেতা বর্তমানের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন। তিনি বলেন, পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে চাননি দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এবং সাধারণ সম্পাদক জহিরুল আলম রুবেল উদ্যোগ নেওয়ায় এরশাদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা সম্ভব হয়। এ বিষয়ে পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ মান্নান. কাজী ফিরোজ রশীদসহ পার্টির বিভিন্ন শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা নিজেদের ব্যবস্তার দোহাই দিয়ে কোন রকম মন্তব্য করতে চাননি। এদিকে নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক অপর এক নেতা বলেন, ‘খুবই দুঃখ লাগে। এরশাদ সাহেবের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আমরা জেলা-উপজেলায় পালন করতে চেয়েছিলাম। এজন্য যত টাকা প্রয়োজন হতো তাও আমরা ম্যানেজ করতাম। কিন্তু জিএম কাদের তা করতে দেননি।’
দলের একটি সূত্র জানিয়েছে , যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের জাতীয় পার্টিতে অবমূল্যায়ন, কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ত্যাগীদের বাদ দিয়ে অযোগ্য ও বিতর্কিতদের পদায়ন, বিভিন্ন সময় পদ বাণিজ্য, পার্টির চেয়ারম্যানকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট, পদ-পদবি ও কমিটি গঠন নিয়ে কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নেতাদের কোন্দল-গ্রুপিং, পার্টির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে দলে এ ‘চুরমার’ দশা বিরাজ করেছে। ঢাকা-৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, বরিশালের সংসদ সদস্য নাসরিন হাওলাদার রতœা আমিন, গাইবান্ধার সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীসহ কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা ছাড়া সাংগঠনিক কার্যক্রমে কেউ খুব একটা তৎপর নন বলে জানায় সূত্রটি। জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, তৃণমূলে কোন্দলসহ নানা ঘটনায় চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দল ও সাংগঠনিক কর্মকা-ে। এসব কারণে জাতীয় পার্টি আগের চেয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন দলটির নেতারা।