প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৪ আগস্ট, ২০২১, ১০:৫১ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়া সারা দেশের ন্যায় উপকূলীয় এলাকায় পৌঁছালেও টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে তার সুফল থেকে বঞ্চিত উপজেলাবাসী। তাদের জীবন-জীবিকা অনেকটাই ঝুঁকির মুখে। বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলের যথাযথ সুরক্ষা না থাকায় স্বাভাবিক জোয়ারেও প্লাবিত হচ্ছে উপকূলীয় এলাকা। এসব কারণে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন দেশের সাগর তীরবর্তী সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, খুলনা, চাঁদপুর, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামসহ ২১টি জেলায় লাখ লাখ মানুষ। অভিযোগ, বসবাসরত এই সব মানুষরা সুরক্ষার অভাবে অনিশ্চয়তার ভেতরে দিন যাপন করছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, উপকূলের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধ যার বেশিরভাগই ভাঙাচোরা ক্ষতবিক্ষত। অনেক জায়গায় বাঁধের চিহ্নও নেই। ইয়াস এবং আম্পানের তা-বে তছনছ উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ। ফলে প্রতি বছর এসব এলাকার বসতভিটা, ফল-ফসলি জমি, ফসলি ক্ষেত, খামার, লবণের মাঠ, চিংড়িও মাছের ঘের, মিঠাপানির উৎস পুকুর-কুয়া-নলকূপ, হাট-বাজার, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে গেছে। অপরদিকে হাজার হাজার একর জমি লবণাক্ত হওয়ায় সেসব জমি এখন চাষের অনুপোযোগী হয়ে পেড়েছে। এসব এলাকায় উঁচু বাঁধ নির্মাণে পরিকল্পনা থাকলেও বাঁধ নির্মাণে নজর নেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের। ভাঙা বাঁধ মেরামতের জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও তাতে রক্ষা পাচ্ছেনা উপকূল। অথচ টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মিত হলে সমুদ্রবন্দর, পোতাশ্রয়, বিমানবন্দর, শিল্প-কারখানা, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদসহ অপার সম্ভাবনা এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে বার বার আশারবানী শুনিয়ে চলেছেন উপকূলীয় অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি তথা সংসদ সদস্যরা। তাদের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণেই উপকূলীয় অঞ্চলে জনজীবনে সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এরপর করোনা পরিস্থিতি এবং সুপার সাইক্লোন আম্পান ও ইয়াসের আঘাত যা উপকূলের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। আগে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে সংকট বাড়লেও বর্তমানে স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে ওই অঞ্চলের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করেছেন ক্ষতিগ্রস্থ উপকূলবাসী।
এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্যরা এবিষয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। নাগরিক সংগঠন ‘সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন’ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ফেইথ ইন একশন’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উপকূলীয় জনপ্রতিনিধি ও নাগরিক ফোরামের আহ্বায়ক সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্রের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্যদের পক্ষ থেকে বক্তৃতা করেন খুলনা-৬ আসনের সাংসদ মো. আক্তারুজ্জামান বাবু, বাগেরহাট-৪ আসনের মো. আমিরুল ইসলাম মিলন, পটুয়াখালী-৩ আসনের এস এম শাহজাদা এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সৈয়দা রুবিনা আক্তার (বরিশাল) ও অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার (খুলনা)।
এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন ডিআরইউ সভাপতি মোরসালিন নোমানি, ডিআরইউ’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক শুকুর আলী শুভ, নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে, কেএনএইচ জার্মানির প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান মুকুল, ফেইথ ইন একশনের নির্বাহী পরিচালক নৃপেন বৈদ্য, স্কাস চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা, লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার ম-ল, সচেতন সংস্থার সাকিলা পারভীন প্রমুখ। সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবির মতে, শুধু জোয়ারের পানিতে উপকূলের নিম্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে তা নয়, সাতক্ষীরা শহরেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই টেকসই বেড়িবাঁধের পাশাপাশি পানি নিস্কাশন ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার কথা বলেন এই সংসদ সদস্য। সংসদ সদস্য আমিরুল আলম মিলন বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণ ঘূণিঝড় সিডরের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। আকাশে মেঘ দেখলেই ওই এলাকার জনমনে আতঙ্ক দেখা দেয়। এই আতঙ্ক থেকে রক্ষায় উপকূলে টেকসই বাঁধের পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে বেড়িবাঁধের ওপর। বাঁধের ক্ষতি হলে তাদের সবকিছু ভেসে যায়। বাড়িঘর নষ্ট ও ফসলের ক্ষতি হয়। তাই ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে জরুরি খাবার না দিয়ে, বাঁধটা শক্ত করে বানানো জরুরি। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উপকূলের অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে উল্লেখ করেন সংসদ সদস্য এস এম শাহজাদা। তিনি বলেন, গুরুত্ব বিবেচনায় না নিয়ে ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়। এতে কেবলই সরকারি অর্থের অপচয় হয়। অথচ উপকূলের জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো পাসের অপেক্ষায় পড়ে থাকে।
সংসদ সদস্য সৈয়দা রুবিনা আক্তার বলেন, ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়, সকলকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে’- প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা বাস্তবায়ন হলেই উপকূলের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা অনুযায়ী সংকট মোকাবেলায় সরকার ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
নদ-নদীয় শুকিয়ে যাওয়া উপকূলের জনজীবনে সংকট বেড়েছে উল্লেখ করে এমপি গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার বলেন, আমরা সংকট সমাধানে জনগণকে সাথে নিয়ে কাজ করছি। করোনা পরিস্থিতি বাঁধার সৃষ্টি করলেও আগামীতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া যাবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উন্নয়ন কাজ সহজতর হবে বলে তিনি প্রত্যাশা রাখেন। অনুষ্ঠানে উত্থাপিত সুপারিশে বলা হয়, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ তহবিল গঠন করতে হবে। জাতীয় বাজেটে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত অর্থ বাস্তবায়নে সমম্বয় করে উপকূলীয় এলাকার জনপ্রতিনিধি ও জনগণকে সম্পৃক্ত করে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। লবণাক্ততার আগ্রাসনের শিকার উপকূলের সুপেয় পানির সংকট নিরসন এবং মৎস্য ও কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সুনির্দ্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। উপকূলের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অবিলম্বে হাওর উন্নয়ন বোর্ডের ন্যায় উপকূল উন্নয়ন বোর্ড গঠন করার দাবি করেন আলোচকরা।