#২১ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ। #গ্রাহকের ১৫ হাজার কোটি টাকার উপরে গচ্ছা। #কেউ কেউ মাত্র ১০ শতাংশ গ্রাহকের অর্ডার করা পণ্য সরবরাহ করে, বাকি গ্রাহকের পণ্য সরবরাহে গড়িমসি করে টাকা আত্মসাৎ করে।
দেশে দিন দিন ই-কমার্স ব্যবসার জনপ্রিয়তা যেভাবে বাড়ছে, তেমনি এর নাম ভাঙিয়ে প্রতারণার চিত্রও বেড়েছে। এতে নিঃস্ব হচ্ছেন হাজার হাজার যুবক। যেখানে বহির্বিশ্বে ই-কমার্স ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠান এবং গ্রাহক উভয়ই লাভবান হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। বারবার প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ ভোক্তারা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ই-কমার্স নিয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকার কারণে একাধিক সিন্ডিকেট গ্রাহকদের প্রতারণার জালে আটকে ফেলছে। দেশ ডিজিটাল হওয়াতে এখন সবকিছুই হাতের মুঠোয়। ফলে এখন ঘরে বসে গ্রাহক যা চাইবেন, তাই পাবেন। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে কয়েক বছরে অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে প্রচুর। ই-কমার্সের মাধ্যমে সব ধরনের পণ্য কেনাকাটা করা যায়। এর খুব জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি চক্র গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা জানান, ই-কমার্স সাইট ডাবল, ট্রিপল লাভে ভাউচার বিক্রি করছে। সেটি আইন আনুযায়ী অপরাধ। আইন অনুয়াযী এভাবে পণ্য বিক্রি করার সুযোগ নেই। ভাউচারে এভাবে ভতর্ুুকি দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে পারে না। দেশের মধ্যে বসে এভাবে পণ্য বিক্রি করা যায় না। এতে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।
জানা যায়, অস্বাভাবিক মূল্যছাড়ের ঘোষণা দিয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য অর্ডার নিয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে অর্ডার করা পণ্য সরবরাহ খুবই কম। কেউ কেউ মাত্র ১০ শতাংশ গ্রাহকের, বাকি গ্রাহকের পণ্য সরবরাহে গড়িমসি করে টাকা আত্মসাৎ করে। সূত্রে জানা যায়, গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের পর প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কেউ কেউ দেশত্যাগ করছেন, বিদেশে পাচার করছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ আলোচিত ২১টি মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তদন্ত করে এমন অভিযোগ পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই ইউনিটের সাইবার পুলিশ সেন্টার মামলার পাশাপাশি সাইবার অপরাধ হিসেবে ই-কমার্স সাইটে নজরদারি শুরু করেছে। ধামাকা শপিং ডটকম নামের একটি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে ৫০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলেও তথ্য পেয়েছে সিআইডি। সর্বশেষ ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার এক হাজার ১০০ কোটি টাকা প্রতারণার মামলা করেছেন ভুক্তভোগী এক গ্রাহক। এতে মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান কারাগারে রয়েছে। এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকের প্রায় পাওনা ১৫ হাজার কোটি টাকার উপরে।
সাইবার তদন্তকারীরা বলছেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করেছি। সেগুলোতে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শত শত গ্রাহকের অভিযোগ করছেন। বর্তমানে নজরদারিতে রাখা রয়েছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
সূত্রে জানা যায়, শুধু ইভ্যালি নয়, লোভনীয় অফারের মাধমে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কারো অফার কম, কারো অবিশ্বাস্য ও লোভনীয় অফারে চলছে তাদের ব্যবসায়িক কর্মকা-। এগুলো হলো- টুয়েন্টিফোর টিকেটি. কম, রোকা ইন্টারন্যাশনাল, ইভ্যালি ডট কম লিমিটেড, গ্লিটার্স আরএসটি ওয়াল্ড, গ্রীণ বাংলা ই-কমার্স লিমিডেট, অ্যানেক্স ওয়ার্ল্ড ওয়াইড লিমিটেড, আমার বাজার লিমিটেড, ফাল্গুনি শপ ডট কম, ই-অরেঞ্জ ডট কম, এনভায়রনমেন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড (ধামাকা শপিং), আদিয়ান মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপ, কিউ-ডটকম, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, এসকে ট্রেডার্স ও মোটরস। এরই মধ্যে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি), ব্র্যাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইউসিবি, সিটি ব্যাংক, ও ঢাকা ব্যাংক ১০টি প্রতিষ্ঠানে অনলাইন মার্চেন্টে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের লেনদেন স্থগিত করেছে। এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইভ্যালি, আলেশা মার্ট, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদিনের প্রদীপ, বুমবুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস ডটকম বিডি। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে কার্ড ব্যবহার করে লেনদেন বিষয়ে গ্রাহকদের সতর্ক করেছে লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্স।
সূত্র জানায়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের টাকা নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যাচ্ছে না। পণ্য বিক্রির টাকা সরাসরি বাহিরে চলে যাচ্ছে । চলে যাচ্ছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টে। এর মধ্যে ধামাকা শপিং ডটকম গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া ৫০ কোটি টাকা বাহিরে পাচার করেছে। অগ্রিম টাকা ‘ইনভ্যারিয়েন্ট টেলিকম’ নামে খোলা একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করেছে ধামাকা। সেখানে আট মাসে ৫৮৮ কোটি টাকা লেনদেন হলেও বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৯৩ হাজার টাকা। এটিসহ সংশ্লিষ্ট ১৪টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে, যার মধ্যে এমডি জসীম উদ্দিনের পাঁচটি, ইনভ্যারিয়েন্ট টেলিকমের সাতটি, মাইক্রো ট্রেডের একটি ও মাইক্রো ফুড অ্যান্ড বেভারেজের একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। জসীম উদ্দিন বিদেশে থাকায় জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। তাকে বেশ কয়েকবার ডাকা হলেও ‘করোনার কারণে দেশে ফিরতে পারছেন না’ জানিয়ে এড়িয়ে গেছেন তিনি। ধামাকার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের আলাদা মামলা হবে বলে জানায় সূত্র। ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও এমডি মো. রাসেলের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এছাড়া ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানসহ ৫ কর্মকর্তার ব্যাপারে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
ই-অরেঞ্জ ডট কমের মো. শুভ নামের একজন গ্রাহক জানান, এ বছরের জুনে ই-অরেঞ্জের ‘সামার ডাবল অফারে’র মাধ্যমে ১৬ লাখ টাকার ভাউচার কেনেন তিনি। এই ১৬ লাখ টাকার ভাউচারে বেশকিছু মোটরসাইকেল কেনার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু প্রায় ২ মাসেও মোটরসাইকেল কেনার সুযোগ পাননি তিনি। কারণ, ই-অরেঞ্জ বলছে, বিক্রিযোগ্য কোনো মোটরসাইকেল তাদের কাছে নেই। মোটরসাইকেল পেতে হলে আরও অপেক্ষা করতে হবে অথবা রিফান্ডের জন্য আবেদন করতে হবে। তবে অনেক ভাউচার ক্রেতা রিফান্ড চেয়েও পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন। এভারে শত শত লোকের অভিযোগ এখন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের।
ভোক্তা অধিদফতর জানায়, দেশে ই-কমার্স ব্যবসার প্রসারের কারণে ভোক্তা অধিকারেও এ সংক্রান্ত অভিযোগ বাড়ছে। সঠিক পণ্য না পাওয়া, যথাসময়ে পণ্য না পাওয়া, রিফান্ড না পাওয়ায় মূলত এ ধরনের অভিযোগই বেশি আসে। প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স শপগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তাদের পাওয়া গেলেও অসৎ উদ্দেশ্যে শুধু পেজভিত্তিক যেসব ব্যবসা আছে, তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এ জন্য ক্রেতাদের বুঝেশুনে অনলাইন থেকে পণ্য কেনার পরামর্শ দেয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসেছে সংশ্লিষ্ট ই-কমার্সের সাথে লেনদেন করা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অনলাইন কেনাকাটায় এখন থেকে পণ্য বুঝে পাওয়ার পর ই-কমার্সের টাকা পরিশোধ করবে গ্রাহক। প্রতিবেদন প্রকাশের পর এক বৈঠক শেষে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক (অতিরিক্তি সচিব) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, সবার ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব। যাতে কোন প্রকার গ্রাহকরা প্রতরণার শিকার না হয়। তবে তিনি বলেন, গ্রাহকের পণ্য কেনার ব্যাপারে আরো সর্তক থাকতে হবে।