বঙ্গবন্ধুর জন্য ৩৬৫ দিনই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়
যারা বঙ্গবন্ধুর আসল আদর্শের সৈনিক তারা কিন্তু ৩৬৫ দিনই বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি যারা আছেন তারা বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ করেন। তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হয় যারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা এবং তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের জীবন পরিচালনা করে। এই মহামানবের স্মৃতি অম্লান হয়ে আছে। তিনি এমনভাবে আমাদের জীবনে কর্মে হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন, যেন মনে হয় আমাদের মাঝেই আছেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাকে শ্রদ্ধা ভালোবাসায় স্মরণ করে আসছি আমরা।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৪২৭তম পর্বে মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) আলোচক হিসেবে উপস্থিত হয়ে এসব কথা বলেন- পটুয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য এস এম শাহাজাদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া কাঞ্চন, গৌরব ৭১-এর সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীন। দৈনিক ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
এস এম শাহাজাদা বলেন, যারা বঙ্গবন্ধুর আসল আদর্শের সৈনিক তারা কিন্তু ৩৬৫ দিনই বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি যারা আছেন তারা বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ করে। তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হয় যারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা এবং তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ নিজের জীবন পরিচালনা করে। তারপরও বিশেষ করে এই আগস্ট মাসে অনেক বেশি মনে করি তাকে আমরা। আমরা যদি চিন্তা করি যে, ওরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে অপছন্দ করত যারা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী এবং যারা ভুল পথে গিয়েছিল। সেদিন তারা যদি শুধু বঙ্গবন্ধুকে অপছন্দ করত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে অপছন্দ করত তাহলে তারা হয়তো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতো। কিন্তু এই লোকগুলো যারা আছেন তারা আসলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে এটাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকেই হত্যা করা কারণ বাংলাদেশকে তারা অস্বীকার করেছে, বাংলাদেশেকে তারা আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যই সেদিন এই কলঙ্কময় অধ্যায়টি রচিত করেছিল। আগস্টের কালোরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিণী আরজু মনি ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন। সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে সরিয়ে দিয়ে সরকারের পরিবর্তন আনাই শুধু নয়, পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বাংলাদেশের যাত্রাপথ ঘুরিয়ে দেওয়াটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ১৫ আগস্টের ভোরেই হত্যার করা ‘জয় বাংলার পরিবর্তে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ এবং বাংলাদেশ বেতার পাল্টে করল রেডিও বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু সর্বোত্তমভাবে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশার অবসান ঘটাতে নিজের জীবন বিপন্ন করেছিলেন। ছাত্র জীবনের শুরু থেকে বাস্তব সমাজে কাজের অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেন। রাজনীতিতে জড়িত হয়েছিলেন দেশের মানুষের দুঃখ ঘোচানোর জন্য। কর্মী থেকে হয়েছেন জাতির পিতা। গণমানুষের প্রিয় নেতা ছিলেন তিনি। কর্মনিষ্ঠ, ধৈর্য, সংগ্রামী চেতনা, আপসহীনতা আর অসীম সাহসিকতার জন্য যুগস্রষ্টা নেতা হয়েছিলেন তিনি। পূর্ব বাংলার ইতিহাস গড়েছেন তিনি। কারাগারে বছরের পর বছর বন্দি মুজিবের বাঙালিদের স্বার্থরক্ষার প্রচেষ্টা ছিল অসামান্য। এইটাতো একটা বিরাট মিরাকেল যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সেদিন বিস্ময়কর ভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। শুধু সেদিনই নয় তাকে মৃত্যুর জন্য আরও অনেকবার টার্গেট করা হয়েছিল। কিন্তু দৈবভাবে তার জীবন প্রতিবারই রক্ষা পেয়েছে। ২১ আগস্টের ঘটনাতো আজ পুরো জাতির সামনে প্রকাশ্য। যারা দেশের উন্নয়নের বিপরীতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা সেদিন বুঝতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আবার এখানে প্রতিষ্ঠিত হবে যদি তার কন্যা বেঁচে থাকে।
অধ্যাপক ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া কাঞ্চন বলেন, আজকে আমার বক্তব্যের শুরুতে আমি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। এই মহামানবের স্মৃতি অমøান হয়ে আছে। তিনি এমনভাবে আমাদের জীবনে কর্মে হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন, যেন মনে হয় আমাদের মাঝেই আছেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাকে শ্রদ্ধা ভালোবাসায় স্মরণ করে আসছি আমরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রাম করেছেন এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য। একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে এমন কোন প্রতিষ্ঠা বা আইন নেই যা তিনি করেননি। মাসটি এলেই তাই মনে পড়ে যায়, সেই ভয়াবহ স্মৃতি, যা আমাদের বেদনায় সৃষ্টি করে নতুন করে যন্ত্রণার। যে বিশাল হৃদয়ের মানুষকে কারাগারে বন্দি রেখেও স্পর্শ করার সাহস দেখাতে পারেনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, অথচ স্বাধীন বাংলার মাটিতেই তাকে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সেই ষড়যন্ত্রের নীল নকশা আজও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। জাতির পিতাকে হারানোর সেই দুঃসহ স্মৃতি দীর্ঘ কয়েক যুগ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সুদূর পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ষড়যন্ত্রকারীরা সপরিবারে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কলঙ্কিত বর্বরোচিত অধ্যায়। আমরা হারিয়েছি বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের মহাকাব্যিক বীর নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। হারিয়েছি তার দুই কন্যা ব্যতিরেকে পুরো পরিবারকে। যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট খুনিচক্র কেবল ব্যক্তি মুজিবকেই হত্যা করেনি। তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তির ওপর আঘাত হানে। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে পিছিয়ে নিয়ে যায়। আগস্ট মাস বাঙালির জন্য একটি বেদনাবিধুর মাস। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হালার ঘটনা ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ষড়যন্ত্র এবং দেশি-বিদেশি চক্রান্তের ভয়াবহ, অমানবিক প্রকাশ। কিন্তু আজ সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে অদম্য গতিতে; বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে উদার-অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বমঞ্চে সম্মানের আসনে আসীন হয়েছে বাংলাদেশ।
এফ এম শাহীন বলেন, পুরো আগস্ট মাসটা আমাদের জন্য শোকের মাস। একটা মানুষ তার সারাটা জীবন আন্দোলন করে গেলেন এই বাঙলার মানুষের জন্য, তাদের স্বাধিকার আদায়ের জন্য, জাতির আত্মমর্যাদা আদায়ের জন্য সেই মানুষটির স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারলাম না আমরা। আমাদের বিশিষ্ট সাহিত্যিক নিরব শ্রী চৌধুরী ১৫ আগস্টের পর একটা কথা বলেছিলেন যে, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতির যে আত্মগাতি চরিত্র সেটা তুলে ধরেছে। আমরা কিন্তু আমাদের জাতির পিতাকে হারাবো সেটা কিন্তু আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারিনি। যদিও আমার জন্ম একাত্তরের পরে। আমাদের বেড়ে উঠা এমন সময় হয়েছে যেখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা বলা যেতো না, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চর্চা করা যেতোনা, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে পায়ের নিছে পিষে এই দেশটাকে অন্য পথে চালানো হয়েছে। ঘাতকের দল পঁচাত্তরে শুধু বাংলাদেশের বর্তমানকেই হত্যা করেনি, তাদের হত্যার লক্ষ্যবস্তু ছিল বাংলাদেশের অতীত আর ভবিষ্যৎও। ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশ যখন উঠে দাঁড়িয়েছে, বাংলার মানুষের সার্বিক মুক্তির বিজয় সরণি যখন নির্মিত হচ্ছে, তখনই পরাজিতরা বিষাক্ত ছোবলটি হানল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট দীর্ঘ ষড়যন্ত্র ও নীলনকশার অংশ হিসেবে হত্যা করা হলো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা এতটাই উৎকট ছিল, ঘাতকের বুলেটের নির্মমতা থেকে বঙ্গবন্ধু স্বজনদের কেউ রেহাই পায়নি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট খুনিচক্র কেবল ব্যক্তি মুজিবকেই হত্যা করেনি। তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তির ওপর আঘাত হানে। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে পিছিয়ে নিয়ে যায়। পঁচাত্তরের ক্ষমতাসীন সামরিক-বেসামরিক এলিটচক্র বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগত অবস্থান ও লক্ষ্য থেকে সরিয়ে এনে একটি ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করে। রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা বেদখল করে এবং সংবিধানের কর্তৃত্ব ধ্বংস করে। কিন্তু আজকে আমরা জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে এসে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এসে দেখছি যে, জাতির পিতার যে স্বপ্ন ছিল সেই স্বপ্নটিকে তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা পূরণ করে যাচ্ছেন।