আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করার পর রাজধানী ছাড়ছে ঘরমুখো মানুষ। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বাস, ট্রেন, লঞ্চগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি ছিল চরম উপেক্ষিত। মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব মানা দূরের কথা, অধিকাংশ বাস, ট্রেন, লঞ্চের কর্তৃপক্ষকে প্রবেশপথে হ্যান্ড স্যানিটাইজার স্প্রে করতেও দেখা যায়নি এদিন। তারা শুধু যাত্রী নিতে ব্যস্ত। এছাড়া লঞ্চগুলোতে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া ও অতিরিক্ত যাত্রী নিতে দেখা গেছে। তবে এ বিষয় মানতে রাজি না অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও লঞ্চ মালাকিরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ মেনেই লঞ্চ ছাড়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের ট্রাফিক বিভাগ থেকে ভোরের পাতাকে জানান, শনিবার ভোর ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ২৭টি লঞ্চ দেশের বিভিন্ন রুটে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ছেড়ে গেছে। এসময়ে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে এসেছে ৫০টি লঞ্চ। ঈদের জন্য অন্যান্য সময়ের তুলনায় এখন লঞ্চ একটু বেশি যাওয়া আসা করছে। আগে যেখানে স্বাভাবিক সময়ে ৮৫টি লঞ্চ ছেড়ে যেত এখন সেখানে ১০২টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে। এবছর লঞ্চের যাত্রী অন্যান্য বছরের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ কম। তবে গার্মেন্টস ছুটি হলে আগামীকাল সোমবার ও মঙ্গলবার একটা চাপ পড়বে। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মানাতে পর্যাপ্ত নৌ ট্রাফিক পুলিশ পন্টুনে মনিটরিং করছে।
আরমান নামের এক লঞ্চ যাত্রী এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘কোথাও নেই স্বাস্থ্যবিধি। যাত্রী ও লঞ্চের স্টাফদের মধ্যে অনেকেই মাস্কও পরেন না। শারীরিক দূরত্ব নেই। লঞ্চে বসার মতো খালি জায়গাও নেই। অর্ধেক যাত্রী উঠাবে কে? লঞ্চে উঠার তো নির্দিষ্ট পথ নেই। চারদিক দিয়ে ওঠা যায়। যে যেভাবে পারছেন লঞ্চে উঠে যাচ্ছেন। লঞ্চ সংখ্যাও কম। অর্ধেক যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চললে অন্য যাত্রীরা যাবে কই। যত বিধিবিধানই করুক যাত্রীদের ভোগান্তি কমবে না। সড়কে, লঞ্চে সবখানেই যাত্রীরা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।’ এ বিষয়ে ঢাকা-চাঁদপুর-ঈদগাঁ ফেরিঘাট রুটের ইমাম হাসান-৫ লঞ্চের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ফয়েজ আহমেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকারের নির্দেশ মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে লঞ্চ ছাড়ব। যাত্রীদের মাস্ক পরার জন্য বার বার হ্যান্ড মাইকে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু যাত্রীরা মানছে না। আমরা তাদের বলতে পারি। কিন্তু যাত্রীরা যদি নিজেদের ভালো নিজেরা না বোঝেন তাহলে আমাদের কিছু করার নেই।’
ভোলা রুটে চলাচলকারী গোরি অব শ্রীনগর-৩ এর যাত্রী হাসান এ প্রতিবেদককে বলেন, ঈদের ভিড় এড়াতে দুইদিন আগেই স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি কিন্তু লঞ্চে মানাটা আসলেই অনেক কঠিন কাজ। ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা লঞ্চে চুপ করে বসে থাকা যায় না। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ বার বার মাইকিং করছে স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য কিন্তু এতে কোনো লাভ হয় না।
এদিকে গত মঙ্গলবার এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে কঠোর ‘বিধি-নিষেধ’ শিথিল করায় ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ছয়টা পর্যন্ত ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে নৌযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ।
তবে, যাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী ২৩ জুলাই সকাল থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নৌপথে সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান (লঞ্চ, স্পিডবোট, ট্রলার ও অন্যান্য) চলাচল বন্ধ থাকবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘আমরা কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে লঞ্চ ছাড়ছি। স্বাস্থ্যবিধি মানতে সব লঞ্চ মালিকদের বলা হয়েছে। কোথাও অতিরিক্ত ভাড়া ও যাত্রী নেওয়া হচ্ছে না। আমরা এবার স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে কঠোর অবস্থানে আছি। তবে নৌযানে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানানো অনেক কষ্টকর বিষয়।’
বাস :সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে ঘুরে দেখা যায় কারও হাতে ব্যাগ, কারও মাথায় কিংবা পিঠে। কেউ কেউ শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে ভিড় করছেন জনসমাগমপূর্ণ। বাস কাউন্টারগুলোর সামনে পরিবহন শ্রমিকদের ডাকাডাকি। যাত্রীদের ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করছেন কেউ। একের পর এক ছেড়ে যাচ্ছে যাত্রীবাহী বাস। টিকিট দিয়ে কাউন্টার থেকে অর্ধেক যাত্রী বাসে উঠানো হলেও কিছু দূর যেতেই সড়কের উপর বাস থামিয়ে টিকিট ছাড়া কন্ট্রাক্টে যাত্রী উঠানো হচ্ছে। বসানো হচ্ছে পাশাপাশি সিটে। টার্মিনালে কিংবা বাসে কোথাও কেউ মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। যাত্রীদের ভিড়ের কারণে নেই শারীরিক দূরত্বও। বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরযানসহ বিভিন্ন যানবাহনে গাদাগাদি করে রাজধানী ছাড়ছেন ঘুরমুখো মানুষ। এতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও নানা ভোগান্তির কথা জেনেও কয়েকগুণ বাড়তি ভাড়ায় ছুটছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। ফলে সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা হচ্ছে না কোথাও। গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদসহ বেশির ভাগ টার্মিনালে দূরপাল্লার বাস কাউন্টারে মিলছে না টিকিট। ফলে টিকিট ছাড়াই কয়েকগুণ বেশি ভাড়া নিয়ে যাত্রী পরিববহন করছে বিভিন্ন পরিবহন।
রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন নোয়াখালী সোনাইমুড়ি এলাকার মো. মহিবুল্লাহ। তিনি ভোরের পাতাকে বলেন, ‘প্রতিবছর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটাই। এবারো বাড়ি যাচ্ছি। ঈদের দু’একদিন আগে ভিড় অনেক বেশি হবে। এজন্য আগেই যাওয়ার চেষ্টা করছি। কাউন্টারে এসে বাসের টিকিট পাইনি। কয়েকজন বললো এখানে অপেক্ষা করতে। টিকিট ছাড়াই আমাদের নিতে পারবে।’ রহিমা নামের একজন বলেন, ‘শুনেছি ঈদের পর ১৪ দিন গার্মেন্ট বন্ধ থাকবে। তাই গ্রামে যাচ্ছি। আমার মতো অনেক মানুষ বাড়ি যাচ্ছে। মানুষ বেশি যাওয়ার কারণে বাস পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কষ্ট করে হলেও বাড়ি যেতে চায় তারা। টিভিতে দেখেছি রাস্তায় জ্যাম। বাস রাস্তায় আটকে আছে। মানুষ অনেক কষ্ট করছে। তবুও বাড়ি যেতে চাই।’
ট্রেন :করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আছে জেনেও পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে রাজধানী ছাড়ছে মানুষ। কমলাপুর রেল স্টেশনে ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপ কিছুটা বেড়েছে। অন্যান্যবারের মতো হুড়োহুড়ি করে ট্রেনে উঠতে হচ্ছে না যাত্রীদের। তবে নির্বিঘেœ ঘরে ফিরতে পারলেও রাজধানীতে ফেরা নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন যাত্রীরা। গতকাল শনিবার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ট্রেন চলাচলের তৃতীয় দিন স্টেশন চত্বরে এমন নির্বিঘœ যাত্রার চিত্র দেখা গেছে। এখনও ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের চিত্র দেখা যায়নি। সকাল সাড়ে ছয়টায় প্রথম সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাত্রা শুরু করে। এরপর শিডিউল অনুযায়ী অন্যান্য রুটের ট্রেন চলতে দেখা গেছে। যাত্রীরাও যথাসময়ে ট্রেনে উঠতে পেরেছেন।
রেল কর্তৃপক্ষ বলছেন, সরকার নির্দেশিত সব শর্ত মেনে ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলা এড়িয়ে অনলাইনে টিকিট কাটতে পেরে খুশি অনেক যাত্রী। তবে সার্ভার জটিলতায় দীর্ঘ চেষ্টার পরে টিকিট পাওয়া নিয়ে অভিযোগ করেছেন অনেকেই। সিলেটে যাওয়ার জন্য শাহ আলী ও তার পরিবার অপেক্ষা করছিলেন জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠার জন্য। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। সময় মতই ট্রেনে উঠতে পারলেন। ট্রেনে ওঠার আগে কথা হয় শাহ আলীর সাথে। তিনি বলেন, ঈদে ট্রেনে যেতে যেসব ভোগান্তি পোহাতে হয় তা অন্যান্য বছরের থেকে একটু কম হয়েছে। অনলাইনে সার্ভার জটিলতার জন্য টিকিট কাটতে পারছিলাম না। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর পেয়েছে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাবা-মার সাথে ঈদ করতে যাবো বাড়ি। কিন্তু ফিরবো কি করে সেটা নিয়ে একটু চিন্তাই আছি।’
নোমান নামে আর এক যাত্রী বলেন, ‘টিকিট পেতে ভালোই সমস্যা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেয়েছি। আমরা স্টুডেন্ট আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো বন্ধ। তাই ফেরা নিয়ে তেমন চিন্তা করছি না।’
কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারোয়ার বলেন, ‘আমরা ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি বেশি। এক সিট খালি রেখেই ট্রেন চলাচল করছে। প্রতিদিন ঢাকা থেকে চলাচল করছে ২৫ জোড়া ট্রেন। ২২ জুলাই পর্যন্ত আমরা অনলাইনে টিকিট দিবো। পরবর্তী নির্দেশনা এলে বাকিটা বলতে পারব।’