দেশে টিকাদান কর্মসূচি ধারাবাহিক অবস্থার মধ্যে রয়েছে: ডা. মোহাম্মদ আবদুল আজিজ। #টিকা সুরক্ষা দিবে না, সুরক্ষা দিবে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা: ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া। #যেভাবেই হোক আমাদের করোনা টিকা নিতে হবে: ডা. মো. সালেহ মাহমুদ তুষার।
পৃথিবীর ইতিহাসে এখন বৃহত্তর টিকাদান কর্মসূচি চলছে এবং প্রতিদিন প্রায় ৪০.৮ মিলিয়ন ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে এবং এই পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৮টি টিকার অনুমোদন দিয়েছে এবং আমাদের দেশে এই পর্যন্ত ৭টি টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই টিকা নিয়ে আমাদের দেশে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু আমাদের বিষয়টা বুঝতে হবে যে, এই টিকা নিয়ে পৃথিবীর অনেক ধনী দেশ এটাকে নিয়ে ব্যবসা করছে, তারা নিজেদের দেশে স্টোরেজ করে রাখছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের কথাও তারা শুনছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে টিকাদান কর্মসূচি আছে সেটার মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আমাদের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ টিকার আওতায় এসে পড়বে কিন্তু সে পর্যন্ত আমাদের আগে বেঁচে থাকতে হবে। আমাদের সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনসহ সামনে আরও যতোগুলো বিধি-নিষেধ আসবে সেগুলো মেনে চলতে হবে।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৩৯১তম পর্বে সোমবার (০৫ জুলাই) আলোচক হিসেবে উপস্থিত হয়ে এসব কথা বলেন- স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল আজিজ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপ কমিটির সদস্য, চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান উদ্যোক্তা ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা গবেষক ডা. মো. সালেহ মাহমুদ তুষার। দৈনিক ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল আজিজ বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এখন বৃহত্তর টিকাদান কর্মসূচি চলছে এবং প্রতিদিন প্রায় ৪০.৮ মিলিয়ন ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে এবং এই পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৮টি টিকার অনুমোদন দিয়েছে এবং আমাদের দেশে এই পর্যন্ত ৭টি টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমরা টিকা দানের কর্মসূচির শুরুতেই অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রেজেনেকা, মর্ডানা ও ফাইজার। আমাদের অপসন ছিল একটি অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রোজেনেকা, তাপমাত্রার কারণে আমরা অন্য দুইটি টিকার দিকে যায়নি। সে প্রেক্ষাপটে আমরা সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে ৩ কোটি টিকার নেওয়ার চুক্তি হয়েছিল। আমাদের এই পর্যন্ত টিকা নেওয়ার যে স্ট্রাকচার আছে সেটার দিকে যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো যে, সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা এসেছে ৭০ লাখ, সিনোফার্ম থেকে ২০ লাখ, কোভ্যাক্স থেকে এসেছে ২৬ লাখ, ভারত থেকে উপহার পেয়েছি ৩২ লাখ এবং চীন থেকে উপহার পেয়েছি ১১ লাখ। এই মোট ১৬৯ লাখ টিকা আমরা পেয়েছি। এই বছরের মধ্যে কোভ্যাক্স থেকে আরও ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা আসবে। এই ডিসেম্বরের মধ্যে আরও ১০কোটি টিকা আসবে। আগামী বছর জনশন এন্ড জনশন থেকে আরও ৭ কোটি টিকা আসার কথা। এই হলো আমাদের টিকা আসার কাঠামো। সরকার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত টিকা আমদানি, উৎপাদন ও উদ্ভাবন; এই তিনটি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহতভাবে করে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে ভারত থেকে আমাদের দেশে টিকা আসার কথা ছিল কিন্তু সেখানে মানবিক বিপর্যয়ের কারণে ও আমেরিকায় কাঁচামাল পর্যাপ্ত না থাকায় আমরা একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম কিন্তু আমরা আশা করছি সামনের দিনগুলোতে ভারতের অবস্থা একটু ভালো হলে আমরা বাকি ৩ কোটি টিকা পেয়ে যাবো। এর মধ্যে চীনের সাথে যে দেড় কোটি টিকার চুক্তি হয়েছে সেটাও এসে পড়বে। সব মিলিয়ে আমাদের টিকাদান কর্মসূচি একটা ধারাবাহিকতার মধ্যে চলে এসেছে। এই টিকা নিয়ে আমাদের দেশে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে, কিন্তু আমাদের বিষয়টা বুঝতে হবে যে, এই টিকা নিয়ে পৃথিবীর অনেক ধনী দেশ এটাকে নিয়ে ব্যবসা করছে, তারা নিজেদের দেশে এটা স্টোরেজ করে রাখছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের কথাও তারা শুনছে না। এর মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে চীন ও আমেরিকার আগ থেকেই একটা দ্বন্দ্ব আছে। আমাদের জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী আরও আগেও একটি বৈশ্বিক প্রোগ্রামে বলেছেন যে, এই টিকাকে গণপণ্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার জন্য এবং যেসব দেশ গরিব রয়েছে সেসব দেশে যাতে টিকা উৎপাদন করা যায় সেক্ষেত্রে ধনী দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, আমি শুরুতেই একটি তথ্য দিয়ে শুরু করতে চাই যে, যুক্তরাজ্যে যেখানে প্রায় বেশিরভাগ মানুষ দুই ডোজের টিকা নিয়েছে তাদের মধ্যে আজকে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে টিকা আসবে এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই টিকা দান কর্মসূচি সফলভাবে চালিয়ে যাবেন কিন্তু এই টিকা দেওয়া পর্যন্ত আমাদের সুস্থ থাকতে হবে এবং এই দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের প্রত্যেককেই। পৃথিবীর অনেক দেশে তাদেও জনগণ ইতোমধ্যে টিকার দুই ডোজ নিয়েছে সেখানে কিন্তু আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে করোনা সংক্রমণের হার বেড়েছে। কারণ এখন পর্যন্ত যতো টিকা আবিষ্কার হয়েছে কোন টিকার ক্ষেত্রে কিন্তু বলা হয়নি যে এই টিকা শতভাগ সুরক্ষা প্রদান করবে। এইজন্য আমাদের বার বার বলা হচ্ছে যে, টিকা নেওয়ার পরেও কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। আজ আপনি সুস্থ আছেন কিন্তু আগামীকাল আপনি সুস্থ থাকবেন কিনা সেটার গ্যারান্টি আপনাদের নিজের নিতে হবে। কিভাবে মানবেন সেটা হলো- আপনি মাস্ক পরিধান করুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, স্যানেটাইজার ব্যবহার করুন, বিনা প্রয়োজনে বাড়ির বাহিরে না বের হবেন না; এই নিয়মগুলো যদি আপনারা মানতে পারেন তাহলে টিকা আসা বা গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত আপনি সুস্থ থাকতে পারবেন। আমি অনেককেই এখন পর্যন্ত দেখেছি যে যারা টিকার দুই ডোজ নিয়েছে কিন্তু তারা আবারো করোনায় আক্রান্ত হয়েছে কারণ ঐ যে একই কথা, কোন টিকাই শতভাগ সুরক্ষা দিবে না। টিকা সুরক্ষা দিবে না, সুরক্ষা দিবে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, আপনার যে মাস্কটি রয়েছে সেটা পরিধান করা। যেখানে সরকার গত দেড় বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের উপায়, পক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষকে বিধি নিষেধ মানানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, চিকিৎসক, জনপ্রতিনিধি, মিডিয়া, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাথে নিয়ে আমাদেরকে এই করোনা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ সেটাকে কোনভাবেই তোয়াক্কা না করে অনেকটা অবহেলা উদাসীনতার মাধ্যমে এই করোনার সংক্রমণের হারটা দিন দিন বাড়িয়ে ফেলছেন। আজকে রাজশাহী খুলনা অঞ্চলে প্রায় ১শর বেশি মানুষ মারা গিয়েছে সেখানে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো যে অনেক মানুষ চুরি করে বর্ডার দিয়ে এপার ওপার হয়েছে যার ফলে তারা সেখানে করোনা সংক্রমণের হারটা সেখানে বাড়িয়ে দিয়েছে এবং মৃত্যুও স্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। আমি শতভাগ আশাবাদী যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে টিকাদান কর্মসূচি আছে সেটার মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে আমাদের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ টিকার আওতায় এসে পড়বে, কিন্তু সে পর্যন্ত আমাদের আগে বেঁচে থাকতে হবে এবং সেজন্য আমাদের সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনসহ সামনে আরও যতোগুলো বিধি-নিষেধ আসবে সেগুলো মেনে চলতে হবে।
ডা. মো. সালেহ মাহমুদ তুষার বলেন, টিকা আসছে আরও আসবে; এই শিরোনামে আজকে আলোচনা করতে পারাটা আমাদের জন্য অনেক ভাগ্যের বিষয় এইজন্য যে পৃথিবীর ১৯০টি দেশ যখন টিকা পায়নি তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে প্রথম দিকে সে টিকাটা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি খুবই দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে যে, যখন আমাদের দেশে টিকা ছিল তখন টিকাদান কেন্দ্রগুলো ঢাকা পড়েছিল মানুষের অভাবে কিন্তু এখন যখন আমরা টিকার ক্রাইসিসের কথা বলছি তখন কিন্তু আমরা দেখছি যে করোনার আরও একটি ধাক্কা আমাদের মধ্যে এসে পড়েছে। এটা হয়তো ভারত কিংবা ইংল্যান্ডেও টিকা নেওয়ার পরও সেখানে এটার প্রকোপ বেড়েছে কিন্তু এটা এতোই বেশি ছোঁয়াচে যে এটা ব্যাপকভাবে এখনো ছড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি এখন টিকা নিয়ে থাকতাম তাহলে হয়তো আমরা এর থেকেও আরও ভালো অবস্থানে থাকতাম। আমরা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে বলতে পারতাম আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেক শক্তিশালী। আমরা চিকিৎসকরা যখন সামনে থেকে চিকিৎসা দিচ্ছি তখন আশঙ্কা নিয়ে চিকিৎসা দিতাম না, আরও শক্তি নিয়ে চিকিৎসা দিতে পারতাম। কিন্তু এখন আমরা এখন একটা ভয়ে আছি, শুধু আমরা নয় প্রত্যেকটা জনপ্রতিনিধিরই কিন্তু একটা ভয়ে আছে সঙ্কায় আছে, শুধু সঙ্কায় না আম জনতা যারা কিনা এখনো মাস্ক খুলে বাইরে বের হচ্ছে, যারা এখনো বিনা কারণে বাইরে ভিড়ের মধ্যে যাচ্ছে, যারা কিনা বাইরে সেনাবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের কার্যক্রম দেখার জন্য বাইরে বের হচ্ছে। তাদের এইযে অহেতুক উৎসুকতার জন্য তার নিজের জন্য, তার পরিবারের জন্য এবং সর্বোপরি আমাদের পুরো বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে গত দশদিনে প্রায় ১ লাখ লোক করোনা আক্রান্ত হয়েছে এবং তারা বৈজ্ঞানিক হিসাব অনুযায়ী আগামী ১০দিনের মধ্যে আরও প্রায় দেড় লাখ মানুষকে সংক্রমিত করতে পারবে। এটা কিন্তু গাণিতিক হারে বাড়ে এবং এই সংখ্যাটা যদি আমাদের আরও বেড়ে যায় তাহলে কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যতই ভালো থাকুক না কেন আমরা চাহিদা অনুযায়ী রোগীদের বেড দিতে পারবো না, অক্সিজেন দিতে পারবো না। স্পেন-ইতালির মতো এতো আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পন্ন দেশে কিন্তু আমরা দেখেছি যে কিভাবে তাদের অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেখানে আমরা অনেক ভাগ্যবান যে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেক মুজবুত হওয়ার সর্তে আমরা এখনো অনেক ভালো অবস্থানে আছি।