রাষ্ট্রে একটা নিয়ম রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের উপযুক্ত কর্মকর্তা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে শ্রদ্ধা জানান। সেখানে নারী বা পুরুষ এই প্রশ্নটা আসবে কেন? রাষ্ট্র একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানাবে, সেখানে কে নারী কে পুরুষ এই প্রশ্নটাই তো অপ্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশের সংবিধানেই স্পষ্ট করে বলা আছে, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন (অনুচ্ছেদ ১৯)।
অনুচ্ছেদ ২৭-এ বলা আছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমানের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
বাংলাদেশে নারীমুক্তির ইতিহাস দীর্ঘদিনের, স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। সুদৃঢ় প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামো, সচেতন সুশীল সমাজের কারণে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে, যা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ শুরু থেকেই কয়েকটি ধারায় সংরক্ষণ রেখে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সনদে (সিডও) স্বাক্ষর করেছে।
বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে। সেখানে রাষ্ট্রীয় কাজে নারীর অংশগ্রহণ ও নারীর প্রতি রাষ্ট্রের আচরণে কোনো রকমের বিভেদ ও বৈষম্য করবে না মর্মে চুক্তিতে উল্লেখিত শর্তাবলী মেনে স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে বাংলাদেশ।
সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ এ বলা হয়েছে, পুরুষের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে নারীর অধিকারসমূহের সুরক্ষা আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠা করা এবং উপযুক্ত জাতীয় আদালত ও অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে কোনো বৈষম্য থেকে নারীকে রক্ষা কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা।
একই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক যে কোনো কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হওয়া থেকে বিরত থাকা এবং সরকারী কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানসমূহ যাতে এই দায়িত্ব অনুসারে কাজ করে, তা নিশ্চিত করা।
অনুচ্ছেদ ১৬ তে উল্লেখ রয়েছে, শরিক রাষ্ট্রসমূহ আইনের দৃষ্টিতে নারী ও পুরুষকে সমকক্ষ হিসেবে বিবেচনা করবে।
রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়েই নারী পুরুষ বৈষম্য প্রতিরোধে রাষ্ট্র একইসাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও সাংবিধানিককভাবে বাধ্য। সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রস্তাব একদিকে যেমন নারীর প্রতি বৈষম্যকেই উস্কে দেয়, অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও অপমানিত করে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এটা অপ্রত্যাশিত।
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাতে নারীদের বাদ দিতে চাওয়ার প্রশ্ন উঠালে রাষ্ট্রের অন্যান্য সেক্টরে দায়িত্বপ্রাপ্ত নারীদের দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের নারী কর্মকর্তা সম্মান জানাতে না পারার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, জানাজায় নারীদের উপস্থিতি নিষেধ, তাই। অর্থাৎ ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে দেখা হয়েছে। এই দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে অন্যান্য সেক্টরেও কী আঙ্গুল তুলা হয় না? এটার জন্য প্রস্তাব তুলা হয়েছে, অন্যগুলোর ক্ষেত্রে তুলতে আর কত দূর? আসলে সংসদীয় কমিটি রাষ্ট্রের গোটা সেক্টরেই নারীর অংশগ্রহণকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
তাদের নিশ্চয়ই জানার কথা, দেশ ধর্মীয়গ্রন্থানুসারে চলে না, দেশ চলে সংবিধানে, আইনে। দেশের সংবিধান ও আইনের কোথাও রাষ্ট্রীয় কাজে নারী পুরুষের ভেদাভেদ করতে বলেনি, বরং বৈষম্য কীভাবে ঘুচানো যায় সেবিষয়ে বিস্তর নির্দেশনা রয়েছে। একইসাথে সিডওতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, প্রচলিত যেসব আইন, বিধি, প্রথা ও অভ্যাস নারীর প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে, সেগুলো পরিবর্তন অথবা বাতিল করার উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়নসহ সকল উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বাংলাদেশ সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২৮ এ বলা আছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংসদীয় কমিটি যেভাবে ধর্ম মেনে এই প্রস্তাব দিয়েছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির সদস্য যে একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী দীপু মনি, এখানেও কি তারা ধর্ম মেনেই করেছেন? তাদের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, যার অধীনে তারা রয়েছেন, তাদের এই প্রস্তাব কি খোদ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যায় না? নাকি সেটা তারা ধর্ম মেনেই গ্রহণ করেছেন! একই কারণে কি মাননীয় স্পিকার শিরিন শারমিনও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যায় না?
সবচেয়ে বড় হাস্যকর বিষয় হলো প্রস্তাবটা তুলেছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বিষয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। লাখো নারীর ইজ্জত ও সম্মানের জন্য যারা লড়েছেন, তাদের সম্মান জানাতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন আমাদের নারীরা। এই লজ্জা কোথায় লুকাবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়? মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীদের অধিকার ইত্যাদি শব্দগুলো একসারিতে দেখে বাংলাদেশ অভ্যস্ত, দেশটিতে সকল ধর্মের, সকল বর্ণের মানুষদের নিয়ে স্বপ্নের বীজ রোপণ করা হয়। আর সেটা হয় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই। এখন সেই মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ই এই সারিতে ফাটল ধরাতে উঠেপড়ে লেগেছে, মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করার প্রায়াস নিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় হয়েও যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিতে জানে না, তাদের কার্যক্রম ও দায়িত্ববোধ নিয়ে বড় করেই প্রশ্ন তুলা যায়।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন ২০২১ প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ৬৫তম অবস্থানে রয়েছে। গত বছরও বাংলাদেশের এ অবস্থান ছিল ৫০তম।
মূলত চারটি প্রধান সূচকের ভিত্তিতে বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। চারটি সূচকের মধ্যে তিনটি সূচকেই আগের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান বেশ পিছিয়েছে, অর্থাৎ এসব সূচকে দেশে লিঙ্গবৈষম্য বেড়েছে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরের প্রতিবেদনের তুলনায় পিছিয়েছে। এই পিছিয়ে যাওয়ার মূলে কী রয়েছে?
আমাদের সমাজে বর্তমানে ধর্মবিশ্বাসের নিয়ামক শক্তিতে পরিণত। রাজনীতিবিদরা পর্যন্ত ধর্মমতকে সমীহ করে পথ চলেন। অনেক সময় বিভিন্ন উগ্রধর্মবাদীদের সঙ্গে আপোস-আঁতাতও করেন। এমনকি ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার পর্যন্ত করেন। কিন্তু ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রে যে সকল আপত্তিকর, জনবিরোধী, মানবতাবিরোধী কথা আছে, তার বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করেন না। ধর্মমতকে এতটাই সবাই সমীহ করেন যে, কেউ আর সাহস করে বলতে পারেন না যে বর্তমান যুগে ওই শাস্ত্রীয় বচন আর অনুকরণযোগ্য নয়।
পুরুষদের স্বার্থে পরিচালিত বিধি-বিধান, ধর্মীয় আচার আর আইন নারীদের সব সময় প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়। সমাজে নারীরা কখনো আপন ভাগ্য জয় করবার সুযোগ তেমনভাবে পায় না। আর সেটা যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হয়, তখন রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বরতদের দিকে তর্জনিই তুলতে হয়।
ইদানীং কেবলই মনে হয়, নারীর সমতা, স্বাধীনতা, ক্ষমতায়ন আর অধিকার নিয়ে সর্বত্র ভুলে ভরা এক ধারণাকে লালন করে চলেছি আমরা। আর এই ধারণাগুলো যখন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা লালন করেন, তখন আমাদের সামনে থাকে শুধুই অন্ধকার। আমার অভিজ্ঞতা বলে, এ ক্ষেত্রে রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা, ইচ্ছাশক্তির অভাব এবং এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাব। অথচ বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনে সবার আগে প্রয়োজন এই সব নীতিনির্ধারকের মনোজগতের পরিবর্তন।