জানা যায়, এমপি ও হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে জমি দখলসহ বিভিন্নভাবে মানুষকে নিঃস্ব করে দেওয়ার অসংখ্য জাল-জালিয়াতির অভিযোগ আছে। নিজ দলের নেতাকর্মীর মুখেও সেসব অভিযোগ শোনা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম চৌধুরী বলেন, শামসুল হক চৌধুরীর জীবনটাই জালিয়াতিতে ভরা। তাঁর জালিয়াতির আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে বাবুর্চিকে জমির মালিক সাজিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে জমি আত্মসাৎ করা। সামশুল হকের জালিয়াতির ফলে জমি হারানো ওই পরিবার প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাঁর জালিয়াতিতে এমন অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ২৫ এপ্রিল বিসিএস প্রশাসনের সদস্য হিসেবে বাকলিয়া কর্ণফুলী আবাসিক প্রকল্পের তিন গণ্ডা দুই কড়া জমির বরাদ্দ পান আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শফিকুল হায়দার মজুমদার। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ওই জমি বিক্রি করে দেন হাজি মোহাম্মদ শফিক আহমেদ নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে। কিন্তু সহজ-সরল শফিকের জমির ওপর নজর পড়ে বর্তমান জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর। জমি গ্রাসের কাজে তিনি ব্যবহার করেন তাঁর তৎকালীন ঢাকার বাসার বাবুর্চি মোহাম্মদ সোলেমানকে।
শামসুল হক চৌধুরী ২০০১ সালে সোলেমান বাবুর্চিকে মোহাম্মদ শফিক আহমেদ সাজিয়ে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য খুরশিদা খানম নামে এক নারীকে রেজিস্ট্রি দেন। ওই দলিলের শনাক্তকারী ছিলেন তিনি নিজে। ২০০২ সালের মাঝামাঝি জালিয়াতির বিষয়টি বুঝতে পারেন সোলেমান বাবুর্চি। নিজের ভুল বুঝতে পেরে ২০০২ সালের ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রামের প্রথম শ্রেণির হাকিম আদালতে হলফনামা দিয়ে জালিয়াতির বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন তিনি। ওদিকে সাড়ে আট লাখ টাকায় জমি কিনে প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরে খুরশিদার পরিবার সামশুল হককে টাকা ফেরত চেয়ে চাপ দিতে থাকে। শামসুল হক চৌধুরী এক প্রকার বাধ্য হয়েই টাকা ফেরত দিয়ে জালিয়াতি করে নেওয়া জমিটি তাঁর ভাই মাহাবুবুল হক চৌধুরীর নামে লিখে নেন। ২০০৬ সালে আমমোক্তারনামা দলিলমূলে জায়গাটির মালিক বনে যান সামশুল হক।
জালিয়াতির বিষয়টি জানাজানি হলে ২০০৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর ওই জমির মালিকের ছেলে মোহাম্মদ মোক্তার সিএমপির বাকলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন (নম্বর-৬৭০)। ডায়েরিতে তিনি বিবাদী হিসেবে শামসুল হক চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে বলেন, শামসুল হক চৌধুরী তাঁর পৈতৃক সম্পত্তিতে যেতে বাধা দিয়েছেন। মারধরেরও হুমকি দিয়েছেন।
সোলেমানের হলফনামায় যা ছিল : সামশুল হক চৌধুরীর প্লট জালিয়াতি প্রকাশ্যে আসার পর মুখ খোলেন সোলেমান বাবুর্চি। ২০০২ সালের ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রামে প্রথম শ্রেণির হাকিম আদালতে হাজির হয়ে হলফনামা দেন। হলফনামায় সোলেমান বলেন, ‘আমি ঘোষণাকারী চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ কে এম মতিন সাহেবের মাধ্যমে পরিচিতির সূত্রে উপরোক্ত এ কে এম মতিন, মুসলিম উদ্দিন ও শামসুল হক চৌধুরীর একত্রে ভাড়ায় নেওয়া ঢাকার বাসায় আমি তাঁদের অধীন বাবুর্চি হিসেবে চাকরি নিই। ওইখানে চাকরি করা অবস্থায় চট্টগ্রামে ছুটিতে এলে ১৫ অক্টোবর, ২০০১ সালে শামসুল হক চৌধুরী আমাকে বলেন, তাঁর এক চাচা বর্তমানে খুবই অসুস্থ আছেন। তাঁর পক্ষে বর্তমানে চলাফেরা করা অসম্ভব। তাই তাঁর পক্ষে একটি দলিলে রেজিস্ট্রি দিতে হবে। তাঁর কথামতো রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে সামশুল হক চৌধুরীর উপস্থিত ও অনুগত কর্মচারী হিসেবে দলিলে টিপসই দিই। আমি কোনো রকমে সাধারণ পড়তে পারি ও দস্তখত জানি। কিন্তু শুধু টিপ দিতে হবে বলায় টিপ দিই। আমি উক্ত দলিলের বিষয়ে কিছুই জানতাম না। আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। উক্ত সামশুল হক চৌধুরীও সাক্ষী হিসেবে দস্তখত করেন। ইদানীং সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত দলিলে গ্রহীতাপক্ষ আমাকে মূল দাতা মনে করে ১৫ অক্টোবর, ২০০১ দলিল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমি উক্ত সম্পত্তির মালিক নই এবং আমি উক্ত সামশুল হক চৌধুরীর কথা ও নির্দেশমতো তাঁর চাচার স্থলে টিপ দিয়েছি জানাই। এ অবস্থায় ভবিষ্যতের জটিলতা পরিহার করতে প্রকৃত তথ্য ও সত্য বর্ণনা করলাম। ১৫ অক্টোবর, ২০০১ সালে চট্টগ্রাম সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত দলিলে আমার দেওয়া টিপের সত্যতা প্রমাণের জন্য নিম্নে আমার টিপ প্রদান করিলাম। অত্র হলফনামায় বর্ণিত উপরোক্ত বিষয়াদি আমার সজ্ঞান ও বিশ্বাসমতে সত্য।’