#একাত্তরের মতো এবারও এই উগ্র মৌলবাদীরা পরাজিত হবে: মে. জে. (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার। #আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও ঢেলে সাজাতে হবে: মায়েদুল ইসলাম তালুকদার। #আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধকে আরও শক্তিশালী করতে হবে: ড. রবিউল ইসলাম।
ধর্মীয় উগ্রতা বলতে আমি যেটা বুঝি সেটা হলো ধর্মের নামে উগ্র আচরণ করা, ধর্মের নামে অতি উৎসাহী হওয়া, এবং ধর্মের নামে অপ রাজনীতি করা এবং জনমনে ধর্মের নামে বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তি তৈরি করা, এবং মানুষকে ধর্মের নামে সহিংস কর্মকাণ্ডে লেলিয়ে দেওয়া। ধর্মীয় উগ্রতার শেষ কোথায়? আসলে আমরা তো আর ভবিষ্যৎ বলতে পারব না কিন্তু বাংলায় একটা কথা আছে 'পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে'। বর্তমানে এই উগ্রবাদীরা যে ভাষা ব্যবহার করছে ঠিক সেই ভাষায় একাত্তর সালে হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আল সামসরা বলেছিলেন। যে সমস্ত অরাজকতা হচ্ছে সেটা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি যদি আমরা আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারি।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ৩০৩তম পর্বে বৃহস্পতিবার (৮ এপ্রিল) আলোচক হিসেবে উপস্থিত হয়ে এসব কথা বলেন- পিএসসি, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, গবেষক ও লেখক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার, জার্মান আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, বাংলাদেশ কালচারাল এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং লেখক মায়েদুল ইসলাম তালুকদার বাবুল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. রবিউল ইসলাম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের প্রাধ্যক্ষ। দৈনিক ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভোরের পাতার সিনিয়র রিপোর্টার উৎপল দাস।
মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, আজকের আলোচ্য বিষয়, ধর্মীয় উগ্রতার শেষ কোথায়? আসলে আমরা তো আর ভবিষ্যৎ বলতে পারবো না কিন্তু বাংলায় একটা কথা আছে 'পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে'। বর্তমানে এই উগ্রবাদীরা যে ভাষা ব্যাবহার করছে ঠিক সেই ভাষায় একাত্তর সালে হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আল সামসরা বলেছিলেন। তারা বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ এবং এদেশের মানুষ যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোক আছে তারা মুসলমান নয়, এরা ভারতের দালাল। এই কথা গুলো কিন্তু আমার কথা নয়, এই কথা গুলো আপনারা জামায়াতে ইসলামের পত্রিকা সংগ্রামের পাতা খুললেই পাওয়া যাবে। সুতরাং সেই পাকিস্তানের সাথে ছিল চীন এবং সর্ব সমর্থন দিয়েছিল আমেরিকা তারপরেও মাত্র নয় মাসের মাথায় তারা যেভাবে আমাদের কাছে পরাজিত হয়েছিল যা কিনা পৃথিবীর সব যুদ্ধের ইতিহাসে এভাবে শোচনীয়ভাবে, অবনত মস্তকে পরাজয় আর কোথাও হয়নি। বহু যুদ্ধ হয়েছে, বহু সারেন্ডার হয়েছে কিন্তু এইরকম লজ্জা জনক পরাজয় আর কোথাও হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মের প্রতি অতি সংবেদনশীল। কিন্তু বৃহত্তর মানুষ গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া তারা ধর্মের গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করে না। তারা উদার নীতি ধর্মে বিশ্বাস করে, মানুষের সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করে, মানুষের ভালোবাসায় বিশ্বাস করে। হেফাজতিরা অতি সম্প্রতি যা করেছে এবং করোনার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণ আন্দোলন, নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা বা তারও আগে সংগঠনটির জন্মের গোঁড়ার দিকে ৫ মে ২০১৩ ঢাকার মতিঝিলে যে তাণ্ডব চালিয়েছে, সবকিছুতে মাদ্রাসার ছাত্রদের হাতিয়ার করে মামুনুলরা যা করছেন, তাতে আমার মনে হয়েছে তারা ১৯৭১ সালের সেই হানাদার ও রাজাকার বাহিনীদের প্রতিনিধি করছে। আসলে তারা এই হানাদার বাহিনীদের রয়ে যাওয়া প্রেতাত্মা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীরই দিনে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিতে যারা আগুন দিলো, শহরটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলো তাদের মূল উদ্দেশ্য কী? অবশ্য প্রকাশ্যে উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমন ঠেকাতে হেফাজতে ইসলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে বিক্ষোভ-সমাবেশের আয়োজন করে। গণতান্ত্রিক একটি দেশে বিক্ষোভ-সমাবেশ হতেই পারে। কিন্তু বিক্ষোভের নামে, রেল-স্টেশনে আগুন দেওয়া, প্রেসক্লাবে হামলা করা, ভূমি অফিস পুড়িয়ে দেওয়া, বিদ্যুৎ অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা করা, ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া কীসের আলামত? এখন আমাদের কথা হলও যে, এই ধ্বংসের শেষ কোথায়? ঐ যে আমি শুরুতেই একটা কথা বলেছি যে, 'পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে' এখন আমরা তো আর ভবিষ্যৎ বলতে পারি না কিন্তু আমাদের ইতিহাস সাক্ষী দেয় তারা কখনো জয়ী হতে পারিনি এবং অবশ্যই ভবিষ্যতে জয়ী হতে পারবে না।
মায়েদুল ইসলাম তালুকদার বাবুল বলেন, বাংলাদেশে উদযাপিত হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মের একশ’ বছর আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর। এই সময়টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে আক্রমণ করছে ৬ যুবক। খুন্তি দিয়ে, কুড়াল দিয়ে ম্যুরালটা নষ্ট করছে তারা। নরেন্দ্র মোদি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেছেন, এটি প্রতিবাদ করার কিছুই নেই। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এসেছেন, হিন্দুত্ববাদী বিজেপির প্রতিনিধি না। তার জায়গায় অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকলে তিনি আসতেন। বায়তুল মোকাররমের হামলাকে পুঁজি করে শুক্রবার শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মাদ্রাসা ছাত্রদের পাল্টা প্রতিবাদ। রাস্তা অবরোধ। পুলিশকে আক্রমণ। প্রতিবাদে ঝরে গেল চার জনের প্রাণ। আবার তার সূত্র ধরে আক্রমণ চলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এরা আসলে কারা? এরা আসলে একটা পরাশক্তি যারা ইসলামকে ব্যাবহার করে দেশে অরাজকতার পরিবেশ সৃষ্টি করে ক্ষমতায় আসতে চাচ্ছে। তাহলে কি আওয়ামী লীগ ইসলামের বিরোধী? কখনোই না। আমরা যদি দেখি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কে করে গিয়েছে, বঙ্গবন্ধু করে গিয়েছে। আমরা যদি দেখি, বিশ্ব ইজতেমার যে বিশাল একটা ব্যবস্থা কে করে গিয়েছে, এটাও বঙ্গবন্ধু করে গিয়েছে। কাকরাইল মসজিদ, বায়তুল মোকাররম কে করে গিয়েছে, বঙ্গবন্ধু করে গিয়েছেন। এখন তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সাড়া দেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করছেন, তারপরে মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন এনেছেন এবং এখান থেকে যারা প্রতি বছর বে হচ্ছে তাদেরকেও যথেষ্ট সম্মানী দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও তিনি করে যাচ্ছেন। এখন এই যে একটা পরাশক্তি ধীরে ধীরে একটা বড় শক্তিকে পরিণীত হচ্ছে এদেরকে আমরা কিভাবে পরাস্থ করতে পারি। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে নাশকতা চালায় হেফাজতের অনুসারীরা। আর এই উসকানির মূল হোতা এই মামুনুল হক। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে পাঠিয়ে মামুনুল হক রিসোর্টে চলে যায় ফুর্তি করতে। এর আগে মতিঝিল শাপলা চত্বরে অনুসারীদের বিপদে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার রেকর্ডও আছে এই মামুনুলদের। আমি মনে করি এখন যে সমস্ত অরাজকতা হচ্ছে সেটা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি যদি আমরা আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারি।
ড. রবিউল ইসলাম বলেন, ধর্মীয় উগ্রতা বলতে আমি যেটা বুঝি সেটা হলো ধর্মের নামে উগ্র আচরণ করা, ধর্মের নামে অতি উৎসাহী হওয়া, এবং ধর্মের নামে অপ রাজনীতি করা এবং জনমনে ধর্মের নামে বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তি তৈরি করা, এবং মানুষকে ধর্মের নামে সহিংস কর্মকাণ্ডে লেলিয়ে দেওয়া। সহিংস ও উগ্রবাদ একটা গ্লোবাল সমস্যা। ২০১৩ সালের ৫ মে প্রায় ১২ ঘণ্টা অবরোধ করে রেখেছিল হেফাজতের নেতাকর্মীরা। ব্লগারদের নাস্তিক উল্লেখ করে ৮৪ জনের একটি তালিকা করেছিল মাওলানা শফীর হেফাজত। রাজীব,অভিজিতসহ সেই তালিকার অনেকেই পরবর্তীতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবি তুললেও সে সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। ইসলাম ধর্মের নামে রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র সেই সময় ছিল, এখনও চলছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে শোষণ-নির্যাতন শুরু হলো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি স্বায়ত্তশাসনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হলে আবারও ধর্মের নামে মনগড়া ফতোয়া দিল এই ইসলামপন্থী দলগুলো। মুজিব শতবর্ষে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ বিরোধী হেফাজতে ইসলাম দেশের বিভিন্ন স্থানে যে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়েছে, তা কেবল ১৯৭১ সালের পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোষর রাজাকার-আলবদরদের ঘৃণ্য ও নৃশংস কর্মকাণ্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মূলত ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজত এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটায়। সাম্প্রদায়িক এই অপশক্তি পাকিস্তানী কায়দায় ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে অতিথি অপমানের যে রুচিহীনতার প্রকাশ ঘটিয়েছে তা বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে হেয় করেছে। ধর্মীয় শিক্ষা আধুনিকায়ন করবার যে প্রচেষ্টা বর্তমান সরকার করছে এটাকে আরও তরান্বিত করা লাগবে। আশু রাজনৈতিক লাভ না দেখে অশুভ শক্তিকে কোঠর হাতে দমন করার জন্য উদ্যোগটা সরকারকে কঠোর হাতে নিতে হবে এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা বোধের জায়গাটি আরও শক্তিশালী করতে হবে। এই জায়গাটিতে লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মী, গবেষক, আমরা যারা বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আছি, আমরা যারা এই প্রগতিশীল বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলাদেশ দেখতে চায়; তাদেরকে একত্রে কাজ করতে হবে।