যার মাঝে মানবতাবোধ আছে সেই মানবসেবায় এগিয়ে আসে। কেহ যদি কাউকে রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে, শীতে কাপড়ের অভাবে কাঁপতে দেখে; প্রতিবেশী যদি ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত্রিযাপন করে, পথের কোন শিশুকে ক্ষুধার তাড়নায় কাতরাতে দেখে; আর সে যদি তার পাশে এসে না দাঁড়ায়, তাহলে বুঝতে হবে তার মাঝে মানবতার লেশমাত্রও নেই।
আল্লাহ বলেন, যে সব লোক ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে, তারা নিঃসন্দেহে অতীব উত্তম সৃষ্টি আর ভাল কাজের মধ্যে দানকে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নৈতিক উৎকর্ষ হিসাবে ধরা হয়েছে।
মোত্তাকীগণের গুনের মধ্যে গরিব দুঃখীদের কল্যাণে ধন-সম্পদ ব্যয়কে আল্লাহ বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এ কারনেই কোরআনের অনেক যায়গায় নামাজের পাশাপাশি দরিদ্রকে অন্ন দানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন: যারা প্রতিপালকের সন্তষ্টির জন্য সবর করে, সালাত আদায় করে, আমি যা দিয়েছি তা থেকে গোপণে ও প্রকাশে ব্যয় করে এবং যারা ভাল দিয়ে মন্দ দূরকরে, তাদের জন্য রয়েছে পরকালের শুভ পরিণাম। সূরা বাকারাতে ইরশাদ হয়েছে: পূণ্যবান তারা যারা ঈমান এনেছে আল্লহার ওপরে, আখেরাত, ফেরেশতা, ও সকল কিতাবের ওপরে যারা সম্পদের প্রতি ভালবাসা সত্ত্বেও অর্থ দান করে আত্মীয় স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফির, সাহায্য প্রার্থী ও দাস মুক্তির জন্য এবং সালাত কায়েম করে।
রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি বিধাবা ও মিসকিনদের সমস্যা নিয়ে ছুটাছুটি করে সে যেন আল্লাহর রাহে জিহাদে লিপ্ত। রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, বেহেশতে এখন বালাখানা আছে, যার ভিতর থেকে বাইরে সব কিছু এবং বাইর থেকে ভিতরে সব কিছু দেখা যায়। এসব বালাখানা আল্লাহ তার জন্য তৈরি করে রেখেছেন যিনি (লোকদের সাথে) কথাবার্তায় নম্রতা দেখিয়েছে, ক্ষুদার্তকে খেতে দিয়েছে, রোজা রেখেছে এবং রাতে এমন অংশে নামায পড়েছে, যখন (সাধারণভাবে) লোকজন ঘুমিয়ে ছিল।
দরিদ্র্যকে খাদ্য দান জান্নাতে পৌঁছার অন্যতম সহজ উপায়। রাসূল (স.) এরশাদ করেন, ‘আল্লারহ ইবাদত কর, দরিদ্রকে খাদ্য দান কর এবং উচ্চ শব্দে সালাম কর। নিরাপত্তা সহকারে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
ইসলাম যেহেতু একটি পুর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, তাই মানবজীবনের প্রতিটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রেখেছে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। সামাজিক জীবন সুস্থ-সুন্দর হওয়ার জন্য মানবতাবোধের কোন বিকল্প নেই। তাই মানবতা বোধ যেন কারো থেকে উধাও না হয়ে যায় সেদিকে ইসলাম রেখেছে পূর্ণ সজাগ দৃষ্টি। আর একারনেই মানবসেবাকে ইসলাম শুধু মানবতার বিষয় হিসেবেই রাখেনি বরং একে উল্লেখ করেছে এক মহৎ এবং পূণ্যের কাজ হিসেবে। সাথে-সাথে নানানভাবে উৎসাহিত করেছে এই মানব সেবার প্রতি।
আল্লাহ তাআলা বলেন, মহান প্রভূ কি আপনাকে এতীম হিসেবে পাননাই? তারপর তিনি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছেন। [সূরা দোহা: ৬]
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূল সা. এর অসহায়ত্বের কথা এবং তাঁকে আশ্রয়দানের কথা উল্লেখ করেছেন।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তারা তাদের খাবারের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্তেও সে খাবার অসহায়, এতীম এবং বন্ধীদেরকে খাওয়ায়। [সূরা দাহার: ৮]
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা অসহায়, মিসকীন, বন্ধীদের খাবার দান করাকে মুমিনেদের বৈশিষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন।
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা কাফেরদের মন্দ স্বভাব বর্ণনা করে বলেন “কাফেরদের যে কয়টা মন্দ স্বভাব এগুলোর মধ্যে একটি হল, আর সে মিসকীনকে খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করেনা। [সূরা মাউন: ৩]
অর্থাৎ অসহায়ের পাশে না দাঁড়ানো, তাদের খোজ-খবর না রাখা, মানব সেবায় এগিয়ে না আসা এটা কাফেরদের স্বভাব। পক্ষান্তরে মুমিনগণ মানবসেবায় থাকে সদা তৎপর।
একবার হযরত ইবনে আব্বাস রা. মসজিদে নববীতে এতেকাফরত ছিলেন। এমন সময় একলোক তাঁর নিকট এসে সালাম দিয়ে চুপ করে বসে পড়লেন। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বললেন, কি ব্যাপার তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুবই চিন্তিত! জবাবে লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূলের চাচাত ভাই! নিশ্চয় আমি খুব চিন্তিত এবং পেরেশান। কেননা অমুক ব্যক্তির নিকট আমি ঋণী আছি। তারপর সে রাসূলের রওজা শরীফের দিকে ইশারা করে বলল, এই কবরওয়ালার ইজ্জতের কসম! এই ঋণ আদায় করার সামর্থ্য আমার নেই।
ইবনে আব্বাস রা. বললেন, আমি কি তার নিকট তোমার জন্য সুপারিশ করব? লোকটি বলল আপনি যা ভাল মনে করেন। একথা শুনে হযরত! ইবনে আব্বাস রা. তৎক্ষণাৎ জুতা পরে মসজিদের বাহিরে আসলেন। লোকটি বলল হযরত আপনি কি এতেকাফের কথা ভূলে গেছেন? তিনি বললেন, না ভূলি নাই। তবে খুব বেশী দিনের কথা নয়, আমি এই কবরওয়ালার কাছ থেকে শুনেছি যে, (এই কথা বলার সময় ইবনে আব্বাসের চক্ষু দিয়ে অশ্রু ঝরছিল) যে ব্যক্তি নিজে অন্য কোন মুসলমান ভাইয়ের কোন প্রয়োজনে চলাফেরা করবে এবং তার জন্য চেষ্টা করবে উহা তার জন্য দশ বছর এতেকাফ করার চাইতেও উত্তম হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সৃষ্টির জন্য একদিন এতেকাফ করে আল্লাহপাক তার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। যার দূরত্ব আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী দূরত্ব হতেও অধিক। (একদিনের এতেকাফের ফযিলতই যখন এরূপ তখন দশ বছর এতেকাফের ফযীলত কী পরিমাণ হবে?) [ফাযায়েলে আমালের সূত্রে তাবরানী বাইহাকী. হাকীম, তারগীব]
এই হাদীস দ্বারা যে বিষয়টি বুঝা যায় সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণণ। আর তা হল কোন মুসলমানের প্রয়োজন পূর্ণ করা। যাকে দশ বছরের এতেকাফের চেয়েও বেশি সওয়াবের কাজ বলা হয়েছে। কুরআন এবং হাদীসে আরো বহু আয়াত এবং হাদীস রয়েছে যা মানব সেবাকে সমর্থন করে। শুধু সমর্থনই না বরং এর প্রতি উৎসাহিতও করে।
লেখক: খতিব, বাইতুন্নুর জামে মসজিদ।