বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাস রক্তাক্ত ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি বা সুবর্ণজয়ন্তীর পোস্টমর্টেম করলে তা ওঠে আসে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ১০ দিনের বর্ণিল গোছানো উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত।
স্বাধীন বাংলাদেশের ও বাঙালি জাতির ঐক্যের প্রতীক জাতির পিতার ১০১তম জন্মদিন ছিল ১৭ মার্চ। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রাম ও নেতৃত্বে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি বা সুবর্ণজয়ন্তী ছিল ২৬ মার্চ।
এ সময়ে পৃথিবী করোনার মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে বিপদগ্রস্ত না হলে দুনিয়ার কত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ বরেণ্য ব্যক্তিরা এ স্বাধীন দেশে আসতেন। এমনকি বাংলাদেশে যতটা উৎসবের আনন্দের রং দেখা গেছে তা আরও বেশি মহোৎসব ও বর্ণিল রং নিত। তবুও করোনার দ্বিতীয় দফা ধাক্কার সময়ে আমাদের প্রতি সম্মান, সৌহার্দ্য, সহানুভূতি জানাতে পাঁচজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এসেছিলেন। উৎসবের ওজন তারা বাড়িয়েছেন। পশ্চিম থেকে পৃথিবীর নানা রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরাও আন্তরিক বার্তা পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশের ৫০ বছরের বিস্ময়কর উত্থানের তারা ভূয়সী প্রশংসা করতে ভোলেননি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেই বিশ্ব রাজনীতির কিংবদন্তি ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, সুলেমান ডেমিরেলকে আমাদের মহান নেতার ৭ মার্চের ভাষণের ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত করেছিলেন। যে মাটিতে ৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণ করেছিল এ সেই পুণ্যভূমি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও ঢাকায় এসেছেন। যদি করোনার বিষের ছোবলে পৃথিবী লণ্ড ভণ্ড না হতো, এত মৃত্যু না হতো, এত আক্রান্ত মানুষের জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ না চলত তাহলে পৃথিবী দেখত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ডাকে ঢাকা হতো জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ঘিরে বিশ্ব রাজনীতির আজকের নায়কদের সরব উপস্থিতি। অসংখ্য দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ বিখ্যাতজনেরা আমাদের মহোৎসবে মিলিত হতেন।
এবারের উৎসবের শেষ দিন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। উৎসবের মাহাত্ম্য এতে বেড়েছে। ভারতই সেই দেশ যারা ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের সেনাদের যুদ্ধে রক্তদান, তাদের জনগণের ও সরকারের ১ কোটি শরণার্থীর আশ্রয়দান, ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের মুজিবনগর বা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা, আশ্রয়, মুক্তিবাহিনী, মুজিববাহিনী ও গেরিলা যোদ্ধাদের অর্থ অস্ত্র ট্রেনিংদান কৃতজ্ঞতার ইতিহাসে আমাদের বন্দী করে রেখেছে। রক্তের ঋণে বেঁধেছে। এমনকি পাকিস্তানে ফাঁসির রায় নিয়ে নির্জন সেলে বন্দী স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর মুক্তি থেকে পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে ও বাঙালি জাতির স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়তে ইন্দিরা গান্ধীর দৌড়ঝাঁপ আমাদের অমিত সাহসী ও ঋণী করেছিল।
সেই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পরম বিশ্বস্ত রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ ছিল ইতিহাসের নির্মোহ বিচারে যথার্থ যৌক্তিক রায়। নরেন্দ্র মোদি এসে আমাদের সম্মানিত করেছেন। দুই দেশের উষ্ণ বন্ধুত্বের কথাই বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না সেটিও বলে গেছেন।
কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এমন দিনে হেফাজতের ডাকে নরেন্দ্র মোদির বিরোধিতা করে উগ্র সাম্প্রদায়িক মূর্তি নিয়ে কেন নামা হলো? কেন বিলুপ্ত প্রজাতির অতি ডানের এতিম থেকে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও পথে নামলেন? গায়ে মানে না আপনি মোড়লরা বিবৃতি দিলেন? কেন একটি সাম্প্রদায়িক উগ্রশক্তির পাশে সাবেক ডাকসু ভিপি নূরেরও মোদি ঠেকাতে নামতে হলো? কেন বিএনপিকে স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচি স্থগিত করে বিক্ষোভ কর্মসূচি দিতে হলো? কেবলই কি ভারতবিরোধী তার রাজনীতি? অদৃশ্য কালো শক্তির অর্থায়নে ও প্রেসক্রিপশনে এরা সেদিন নেমেছে। বায়তুল মোকররম মসজিদকে তাদের রাজনীতির আশ্রয়স্থল করে সন্ত্রাস করেছে। মসজিদের পবিত্রতা এভাবেই এরা বারবার নষ্ট করে। এই যে হাটহাজারী থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাণ্ডবে গরিবের সন্তানের রক্ত ঝরল উগ্র কর্মকান্ডে এর দায় কে নেবে? সরকার বা অন্য কারও নয়। এই দায় হেফাজত নেতাদেরই নিতে হবে। শাপলা চত্বরে এক দিন তারা চরম প্রতিহিংসা নিয়ে জেগে উঠেছিল। ব্যাংক বাণিজ্যিক পাড়ায় ধ্বংস লীলা চালিয়ে ছিল। সরকার পতনের স্বপ্ন তাদের মিত্ররাও দেখেছিল।
বিএনপিও তাদের পাশে দাঁড়ানোর কঠিন ডাক দিয়েছিল। সরকার ক্ষিপ্র হাতে দক্ষদের নেতৃত্বে সেদিন দমন করেছিল। আজ সুবর্ণজয়ন্তীকালে যখন সর্বক্ষেত্রে দেশ অগ্রসর- তারা এটা মানতে পারে না। তারা শিক্ষায় জ্বলে গবেষণায় পুড়ে। নারীর ক্ষমতায়নে হিংস্র হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন না করে তাণ্ডব করে। যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে আক্রমণ করে। তারা আবার শাপলা চত্বরে মহা তাণ্ডব চালাতে চায়। যারা বলেন হেফাজত রাজনীতিতে নেই- তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করেন। এরা উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষাক্ত মুখ। এদের পেছনে শক্তিশালী উচ্চাভিলাষী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শক্তি। আইএসআইয়ের কালো হাত।
হেফাজতকে কওমি মাদরাসার কোমলমতি পথঘাট না চেনা ছাত্রদের ওপর নির্ভর করে দাবার গুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। সাম্প্রদায়িক উগ্রশক্তির কাজই হলো ধর্মের নামে রাজনীতির বাতাসকে বিষিয়ে তোলা। উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কাজই হলো ধর্মের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তাদের পক্ষে টানা। সমাজ-রাজনীতি, সরকারকে অশান্ত করে রক্তের হোলিখেলা। সুমহান মুক্তিযুদ্ধে এ শক্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। এদের বাবারা ৭১ সালে পাকিস্তানের হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছে। কেউ আলবদর আলশামস হয়েছে। কেউ শান্তি কমিটিতে গেছে। কেউ গেছে রাজাকার বাহিনীতে। কেউ গেছে ধর্মের নামে পাকিস্তানের পক্ষে ফতোয়া দিতে। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি জড়িয়ে আছে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তারা আল্লাহ রসুলে বিশ্বাসী ছিলেন। তারা ধর্মপ্রাণ হলেও সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তাদের অপরাধ তারা স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। তারা বঙ্গবন্ধুর নৌকায় ভোট দিয়েছিলেন। ওদের দোসররা ধরিয়ে দিয়েছে আর হানাদার বাহিনী আড়াই লাখ মা-বোনকে ভয়ংকরভাবে ধর্ষণ করেছে অমানুষের মতো। ধর্ষিতাদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। পাকস্তানি হানাদার বাহিনী সেদিন কে মুসলমান কে হিন্দু দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্ম বর্ণের মানুষ গেছে। ওরা বুদ্ধিজীবীদের ধরিয়ে দিয়েছে। হানাদার বাহিনী তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। বুদ্ধিজীবীদেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ছিলেন। ধর্মও এদের কাছে বড়-ছিল না, পাকিস্তানই বড় ছিল।
আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে কত সংগ্রাম, কত আত্মবিলদান সে বিশাল ট্র্যাজেডি। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু হলেন জাতির পিতা। কোমল তাঁর হৃদয়খানিজুড়ে দেশ ও মানুষ। চরিত্রে আপাদমস্তক উদার গণতন্ত্রী। সেই মহান নেতাকে শান্তি দেননি চীনাপন্থি অতি বিপ্লবী থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের উগ্র হঠকারী রাজনৈতিক শক্তি। নিষিদ্ধ আন্ডারগ্রাউন্ড শক্তির লাল সন্তানতো ছিলই। সবাই মিলে মুজিব উৎখাত, সবাই মিলে ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির বিষের তাস। বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ধাঁচে সংবিধান দিলেন। কী আধুনিক। মূলনীতিতে ঠাঁই পেল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উৎস বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সব রাজনৈতিক শক্তি ও মানুষের আকাক্সক্ষাকে লালন করলেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেন।
৭০ সালেও নির্বাচনে পরাজিত ধর্মভিত্তিক মুসলিম লীগ, জামায়াত, নেজামে ইসলামসহ কিছু দল উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়েছিল। ৭১ সালে তারাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হলো। মুক্তিযুদ্ধের চরম বিরোধিতা শুধু নয়, তারা পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করল। সেই নিষিদ্ধ শক্তি অতি বিপ্লবী আর উগ্রপন্থি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু দলে ঠাঁই নিল। নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে তাদের অ্যাসাইনমেন্ট চালাল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার পরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন বর্বর হত্যাকান্ডের নজির নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর খুনি মোশতাক থেকে ক্যু পাল্টা ক্যুর মাধ্যমে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থা চালু করে যে বিএনপি গঠন করলেন তার শক্তি হিসেবে নিলেন আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী চীনের অনুসারী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের। আর নিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী মুসলিম লীগকে। সেই সঙ্গে বাজারে ছেড়ে দিলেন জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক যুদ্ধাপরাধীর শক্তিকে। গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল হলেও ফিরিয়ে আনলেন। তিনি ও তার দলের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত হলেও রাজনীতিটা করলেন বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আর আবেগ অনুভূতির বিরুদ্ধে। ক্ষমতায় জোটালেন অনেককে। সুবিধাবাদীরা তো ছিলেনই। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের বিচারও নিষিদ্ধ করলেন। বঙ্গবন্ধুর নামও নিষিদ্ধ। ইতিহাসও নিষিদ্ধ। সেই সঙ্গে চলল ইতিহাস বিকৃতি।
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে সততা-দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে বড় ট্র্যাজেডি। সেই ট্র্যাজেডি থেকে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ফের রক্তদানের ইতিহাসে সামরিক শাসনের অবসান হলেও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে আর ফিরতে পারেননি। সংবিধান সেই যে এলোমেলো কাটাছেঁড়া করে গেলেন সেনাশাসকরা তাতে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তান ও তাদের মিত্ররা আনন্দিত হলেও আমাদের শহীদদের আত্মার সঙ্গে এ কঠিন বিশ্বাসঘাতকতা।
স্বাধীনতা আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খল, শোষণ শাসন বৈষম্যের অন্ধকার থেকে মুক্তি দিল স্বাধীন জাতি হিসেবে। স্বাধীন আবাসভূমি বা মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে গর্ব নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাঁচার অধিকার দিয়েছে। জাতীয় পতাকা দিয়েছে। জাতীয় সংগীত দিয়েছে। ৭১-এর পরাজিত শক্তির দাসরা জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি তোলার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। বারবার বঙ্গবন্ধুর ছবি, ম্যুরাল, শহীদ মিনারে আক্রমণ করেছে।
এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান হলেও, এ দেশে সব ধর্মের বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা হজে যায়, নামাজ পড়ে, শবেবরাতের রাত জেগে আল্লাহর নৈকট্য চায়, নামাজ পড়ে। জিকির আজগার করে। শুক্রবারে জুমায় মসজিদে ঢল নামে। সব ধর্মের মানুষই এভাবে নিজ নিজ ধর্মের উপাসনা করে। এটা তার অধিকার। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা ধর্মান্ধতা উগ্র সাম্প্রদায়িকতা দূরে থাক, সাম্প্রদায়িকই নয়। চিন্তা মননে অসাম্প্রদায়িক। তাই বাংলা নববর্ষে একুশে বিজয় দিবসে, স্বাধীনতা দিবসে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতির প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। ঢল নামে সারা দেশে কোটি মানুষের।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যারা নরেন্দ্র মোদিকে ঘিরে সহিংস তাণ্ডব করেছে তারা ওসব দিবস মানে না। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও তার সংস্কৃতি মাদরাসার ছাত্রদের শেখানো হয় না। মাদরাসার ভিতরে কী বর্বরতা সেটি গত কয়েক বছর বেরিয়েছে। হাই কোর্টেরও নির্দেশনা আছে। সেদিন মোদির জায়গায় ইমরান খান এলে দেশে প্রতিবাদের ঝড় তুললেও মামুনুল হক এবং তাদের নেপথ্যের শক্তি আনন্দিত হতো। ওরা ৭১-এর বিরুদ্ধে ছিল আজও বিরুদ্ধে। বংশ পরম্পরায় এটা চলবে তাদের। তারা ৭১-এর পাপের জন্য পাকিস্তানের নেতা হিসেবে ক্ষমা চাইতে বিক্ষোভ করত না। আমাদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে বলত না। বরং স্বাগত জানাত মারহাবা খোশ আমদেদ বলে। এখানে তাদের আত্মা। মোল্লা ওমরের তালেবানি দর্শন তাদের চেতনা। এদের হালাল হারাম বড় বেশি ইতিহাসে চেনা।
দেশ এত ট্র্যাজেডি এত বিপর্যয়েও এগিয়েছে। বিশ্বে আজ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নের বিস্ময়। উন্নয়নশীল দেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় উদীয়মান শক্তি।
৫০ বছরে দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। বঙ্গোপসাগরে আরেক বাংলাদেশ জেগে ওঠছে। মঙ্গা দুর্ভিক্ষ নির্বাসনে গেছে। গৃহহীনরা ঘর পাচ্ছে। মানুষ এখন সচ্ছল হয়েছে, হচ্ছে। ভাত-কাপড়ের অভাব দূর হয়েছে, হচ্ছে। দেশে কত কত শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠেছে। কৃষিতে বিপ্লব ঘটে গেছে। গ্রামের পর গ্রাম আলোকিত ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। অবকাঠামোর উন্নয়ন এগিয়ে যাচ্ছে। শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মানুষও এখন সন্তানকে পড়ালেখা করায়। তবে বৈষম্য কমেনি। শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হয়নি। ৫০ বছরে সবচেয়ে দুর্বল হয়েছে রাজনৈতিক শক্তি। যে রাজনৈতিক শক্তি দেশের জন্ম দিল সেখানে আজ রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষমতাবান দাপুটে হচ্ছে দিনে দিনে। এ এক সর্বনাশা আলামত।
বামপন্থি রাজনীতির বাতি নিভে যাওয়ায়, মানুষের পক্ষে কথা বলার শক্তি দুর্বল। আদর্শিক রাজনীতির মৃত্যু বড় সর্বনাশ বয়ে এনেছে। আওয়ামী লীগকে সাম্প্রদায়িক কালো শক্তির বিরুদ্ধে আপস নয়, প্রতিরোধ নীতিতে লড়াইটা করতে হবে। দলকে আদর্শিক চেতনায় জাগাতে হবে। জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্য সুসংহত করে গণজাগরণ ঘটাতে হবে। এদের সঙ্গে আপস চলে না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এ শিক্ষা দেয় না।
আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। নেতৃত্ব ও আদর্শের জায়গা থেকে উগ্র শক্তিই নয়, সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গেও তারা আপস করতে পারে না। নেতা-কর্মীদের বঙ্গবন্ধুর বই পড়ে ঘুমালেই হবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ জীবন ও নীতি নৈতিকতা লালনের পাঠ নিতে হবে। লোভ-লালসা, ক্ষমতার বেহুঁশি দম্ভ আচরণ, দুর্নীতি অসততা থেকে মুক্ত হয়ে মানবকল্যাণে গণমুখী রাজনীতি করতে হবে। আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে সাম্প্রদায়িক শক্তি দূরে থাক একজন সাম্প্রদায়িক মানুষও তাদের ভোট দেয় না কখনো। দিতে পারে না। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ৭০ সালেও দিয়েছে, এখনো দেয়। কিন্তু ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ভোট নৌকায় পড়ে না। বিরোধী শক্তির মার্কায় পড়ে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
ভোরের পাতা/কে