না বলা যায়, না সওয়া যায়। লাগামহীন বাজারদরে দিশেহারা হয়ে পড়েছে মধ্যবিত্ত। করোনা মহামারির এ সময়ে সাধারণ মানুষের আয় কমলেও ব্যয় বেড়েছে।
এরমধ্যে বছরঘুরে এসেছে পবিত্র রমজান মাস। রমজান মাস মানেই বাড়তি আয়োজন বাড়তি খরচ। এ পবিত্র মাস উপলক্ষে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে পণ্যের মূল্যছাড় দিলেও বাংলাদেশে চিত্র ভিন্ন। এখানে রমজান মাসকে মুনাফা লাভের মাস হিসেবে নিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেট করে সব পণের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। সাধারণ মানুষ বাজারে গেলেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে পকেট।
পবিত্র রমজান মাস আসার আগেই প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। সরকারের বিপণন সংস্থা (টিসিবি) বলছে, টানা এক মাস ধরে বেড়ে চলেছে অন্তত ১২টি পণ্যের দাম। পণ্যগুলো হলো- সয়াবিন তেল, চিনি, মশুর ডাল, মুগডাল, পেঁয়াজ, আটা, ময়দা, গরুর মাংস, খাসির মাংস, মুরগি, গুড়া দুধ, হলুদ, আদা, জিরা।
ক্রেতারা বলছেন, পবিত্র রমজান মাসকে পুঁজি করে মুনাফাখোররা এই পণ্যগুলোর দাম পরিকল্পিতভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে সীমিত আয়ের মানুষরা পড়েছেন বিপাকে। নতুন করে বেড়েছে খোলা সয়াবিন, আটা, ময়দা, ব্রয়লার মুরগি, গুড়া দুধ, চিনিসহ অন্তত আরও ৬টি পণ্যের দাম।
বাজারের তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে লিটারে এক থেকে দুই টাকা। ৫ লিটার বোতলের দাম বেড়েছে ১০-২০ টাকা পর্যন্ত। এক লিটার বোতলের দাম বেড়েছে ৬ টাকা। প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে কেজিতে দুই টাকা। খোলা ময়দার দাম বেড়েছে কেজিতে দুই টাকা। ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকা। চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ টাকা।
টিসিবির তথ্য বলছে, গত এক মাসে আটার দাম বেড়েছে ১.৪৭ শতাংশ। গত মাসে যে আটার দাম ছিল ৩৫ টাকা এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩৬ টাকায়। ৩৫ টাকা কেজি ময়দার দাম বেড়ে হয়েছে ৩৮ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৫.১৫ শতাংশ। ১১৫-১১৮ টাকা দামের সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১১৯-১২৬ টাকায়। গত মাসে এই এক লিটার বোতলের দাম ছিল ১৩০ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৩৬-১৪০ টাকায়। আর ৫ লিটার বোতল তেল এখন ৬২০-৬৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা পামওয়েলের দাম বেড়েছে ৭.৯২ শতাংশ। এখন পামওয়েল তেল ১০৮-১১০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। গত এক মাসে পামওয়েল সুপারের দাম বেড়েছে ৮.৭০ শতাংশ। পাম (সুপার) এখন বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকা।
টিসিবি’র হিসাবে গত এক মাসে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ। এক মাস আগে এই মসুর ডালের দাম ছিল ৯৫ টাকা কেজি। এখন সেই ডাল বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজি দরে। ১২০ টাকা কেজি মুগ ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা কেজি। রোজাকে সামনে রেখে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৮.৩৩ শতাংশ। টিসিবি’র হিসেবে ২৬ ফেব্রুয়ারি যে পেঁয়াজের দাম ছিল ২৫ টাকা কেজি। এখন সেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকা কেজিতে। আর আমদানি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকা। এক মাস আগে এই পেঁয়াজ ছিল ১৮-২০ টাকা। ১৪০ টাকা কেজি দেশি হলুদের দাম বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা। ৬০ টাকা কেজি আমদানি করা আদার দাম ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৭০ টাকা। জিরার দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ। এক মাস আগের ২৮০ টাকা কেজি জিরা এখন বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা দরে।
ঠিক এক বছর আগেও এক কেজি মোটা চাল ৩৪ থেকে ৪০ টাকায় কিনতে পেরেছে সাধারণ মানুষ। সেই চাল কিনতে এখন লাগছে ৪৪ থেকে ৫২ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশের বেশি। একইভাবে ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা লিটারের সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে সাড়ে ৩৭ শতাংশ। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন কিনতে হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। চাল-তেলের মতো আটা, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস, গুঁড়া দুধ, রসুনসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে স্বল্প আয়ের মানুষ চাপে পড়েছে।
গত তিন মাসেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে বেশি। তার আট-নয় মাস আগে থেকেই করোনায় বিপর্যস্ত দেশ।অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। বেতনও কমেছে অনেকের। নতুন চাকরির বাজারও নড়বড়ে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেননি। সব মিলিয়ে কঠিন সময় পার করছে স্বল্প আয়ের মানুষ।
করোনাকালের শুরুতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও চাকরি হারিয়ে স্বল্প আয়ের অনেক মানুষ রাজধানী ছেড়েছে। তখন অনেক বাড়ির মালিকই নতুন ভাড়াটে পাননি। গত বছরের শেষ দিকে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও নতুন বছরে বাড়িভাড়া বাড়ানোর পথে হাঁটেননি অধিকাংশ বাড়ির মালিক। সরকারও নতুন করে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মূল্য বৃদ্ধি করেনি। এখন নতুন করে আবার করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। নিত্যপণ্যের দামেও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। অন্যান্য বছরের ধারাবাহিকতায় পবিত্র রমজান মাস ঘিরে আবারও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় আছে সাধারণ মানুষ।
সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠান ট্রাস্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (টিটিআই) সাথে দীর্ঘদিন ধরে ঠিকাদারি করেন নুরে আলম শাহেদ। ভোরের পাতাকে তিনি বলেন, শুরুতে সবকিছু ভালোই চলছিল। ভেবে ছিলাম সবকিছু ঠিক থাকলে এবছর বিয়েটা করে ফেলবো। কিন্তু বিধিবাম গত বছর করোনার কারণে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। করোনার কারণে গত একবছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির (টিটিআই) কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বকেয়া বিলও পাচ্ছি না। ঢাকায় বাসা ভাড়া, খাওয়া মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছি। বিয়ে এখন বিলাসিতা নিজের মত খেয়ে বেঁচে থাকাই দায়। আমার বাবা নেই পুরো পরিবারটিকে আমাকেই দেখতে হয়। এদিকে সামনে রমজান মাস সবকিছুর দাম বাড়তি এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলে কয়েকটি পণ্য কেনার পর পকেট খালি হয়ে যায়। এ অবস্থায় কি করবো বুঝতে পারছি না।
এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম ১০ মার্চ এক জরিপের তথ্য প্রকাশ করে বলেছে, বেতন বা মজুরির বিনিময়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে ৬২ শতাংশ কর্মী বা শ্রমিকের মজুরি ২০১৯ সালের চেয়ে গত বছরের মার্চ-ডিসেম্বর সময়ে কমে গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে বাজারে যেসব পণ্যের দাম বাড়তি, সেগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের সম্পর্ক রয়েছে। তবে শুল্ক ও কর কমানো গেলে কয়েকটি পণ্যের দাম কিছুটা হ্রাস পাবে, যেমন সয়াবিন তেল ও চিনি। গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বাজারগুলোতে ময়দা, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচের পাশাপাশি দাম বেড়েছে বোতলজাত সয়াবিন তেলের। বিপরীতে সরু চাল, খোলা সয়াবিন, পাম অয়েল, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, ছোলা, আলু, রসুন, ব্রয়লার মুরগি ও খেজুরের দাম কমেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
রাজধানীর শাহজাহানপুর, মালিবাগ বাজার, কারওয়ান বাজার, বাদামতলী বাজার, সূত্রাপুর বাজার, শ্যামবাজার, কচুক্ষেত বাজার, মৌলভীবাজার, মহাখালী বাজার, উত্তরা আজমপুর বাজার, রহমতগঞ্জ বাজার, রামপুরা ও মিরপুর-১ নম্বর বাজারের পণ্যের দামের তথ্য নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে টিসিবি।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, বোতলের পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম গত এক সপ্তাহে বেড়েছে ১ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২৩ মার্চ এই দাম বাড়ে। এতে বোতলের পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ৬২০ থেকে ৬৫০ টাকা। গত ২৮ মার্চ লুজ সয়াবিন তেল ও লুজ পাম অয়েলের এবং ২৯ মার্চ সুপার পাম অয়েলের দাম কমেছে বলে টিসিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ কমে ১১৭ থেকে ১২০ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে। লুজ পাম অয়েলের দাম ২ দশমিক ৩০ শতাংশ কমে ১০৫ থেকে ১০৭ এবং সুপার পাম অয়েলের দাম ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ কমে ১১০ থেকে ১১২ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে।
টিসিবি বলছে, সপ্তাহের ব্যবধানে প্যাকেট ময়দার দাম ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেড়ে কেজি ৪৩ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এতে এই পণ্যটির কেজি এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৪ থেকে ৩৮ টাকা। ২৯ মার্চ খোলা ও প্যাকেট উভয় ধরনের ময়দার দাম বেড়েছে।
দাম বাড়ার তালিকায় থাকা আমদানি করা শুকনো মরিচের দাম ৩ শতাংশ বেড়ে এখন কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৩৫ থেকে ২৮০ টাকা। ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ বেড়ে দেশি হলুদ ১৫০ থেকে ২২০ এবং আমদানি করা হলুদের দাম ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়ে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। হলুদের মতো আমদানি করা ও দেশি উভয় ধরনের আদার দাম গত এক সপ্তাহে বেড়েছে। দেশি আদার দাম ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেড়ে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ১২০ টাকা। আমদানি করা আদাও ৭০ থেকে ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এতে সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
টিসিবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সপ্তাহের ব্যবধানে এক কেজি ডিপ্লোমা গুঁড়া দুধের দাম দশমিক ৮১ শতাংশ বেড়ে ৬২০ থেকে ৬৩০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। মার্কস গুঁড়া দুধ এক কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৫৯০ টাকা। এতে সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে দশমিক ৮৮ শতাংশ। ডানো গুঁড়া দুধের দাম দশমিক ৮১ শতাংশ কমে ৬১০ থেকে ৬২০ এবং ফ্রেশ গুঁড়া দুধের দাম ১ দশমিক ৭২ শতাংশ কমে কেজি ৫৪০ থেকে ৬০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এদিকে রোজার সময় কাছাকাছি চলে এলেও রোজায় বেশি ব্যবহৃত হওয়া ছোলা, খেজুর, পেঁয়াজের দাম কমেছে বলে টিসিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, সপ্তাহের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমে কেজি ৩২ থেকে ৩৫ টাকার মধ্যে চলে এসেছে। আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ টাকা। এতে সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কমেছে ১০ দশমিক ৭৭ শতাংশ। সরু চাল মিনিকেট ও নাজিরের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ কমে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৪ টাকা। মসুর ডালের দাম এক সপ্তাহে কমেছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এতে মাঝারি দানার মসুর ডালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা। ছোলার দাম ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমে কেজি ৬৫ থেকে ৭৫ টাকার মধ্যে চলে এসেছে বলে জানিয়েছে টিসিবি।
সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে আলুর দাম ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমেছে। এতে এখন এক কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ১৬ থেকে ১৮ টাকা। দেশি রসুনের দাম ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ কমে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকা। আমদানি করা রসুনের দাম ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ কমে কেজি ৯০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে সাধারণ মানের খেজুরের দাম ৩৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ কমে কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ৩০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির দামও গত এক সপ্তাহে কমেছে বলে জানিয়েছে টিসিবি। সপ্তাহের ব্যবধানে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ কমে ব্রয়লার মুরগির কেজি এখন ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।