'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' পড়ে শেষ করার পরও তৃপ্তি আসেনি আমার। একদিন বাবা খাবার টেবিলে গল্প করছিলেন সে গ্রন্থে রানী রাসমনির কথা আছে। আমি তর্ক করলাম- তুমি পড়নি বেগম মুজিব সেই কবেই খুঁজে বেড়িয়েছেন তাঁদের পূর্বপুরুষ একজনের ডায়েরির পাতা! আসলে বঙ্গবন্ধু কিংবা বাবার মুজিব ভাই জেঠার শেখ সাহেব আর সাদা-কালো বাঁধানো টিনের ঘরটায় নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা নজরুল রবীন্দ্রনাথের সাথে সাথেই আমাদের পরিচয় বঙ্গবন্ধুর সাথে।
চাকরি করছি প্রায় এগারো বছর। এরমধ্যে নয় বছর শিক্ষকতা। ক্লাসের ফাঁকে বইয়ের ভাঁজে ছড়িয়ে দিতাম আমাদের বঙ্গবন্ধুকে। সেটি ছিলো এক রকমের আস্বাদ। কিন্তু গেলো প্রায় একবছর নয় মাস সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট এর কর্মকর্তা এবং হঠাৎই অতিরিক্ত দায়িত্ব পাই " জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি"তে কাজ করার। এ বিষয়টি ছিলো আমার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং কাজ করবো ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী স্যারের সাথে। এর সাথে যুক্ত একটি অনবদ্য দল।
বঙ্গবন্ধু ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন, স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে জীবন তিনি অতিক্রম করেছেন সেটি আদতে ক্ষণজন্মা। আমি পড়তে পড়তে এক সময়ে কাঁদছিলাম - রেণু লুকিয়ে তাকে টাকা দিতো। কোথা থেকে আসতেন আবার চলে যেতেন দেশের মানুষের জন্য কোথায়! জেল আর বন্দি জীবম আন্দোলন সংগ্রাম ; বৃদ্ধ বাবা মায়ের কাছ থেকে দূরে দূরে থেকেছেন। আদতে সংসার বা স্নায়ুবিক জীবন বলতে যা বুঝায় তা তাঁর ছিলোনা। কেবল ছুটেছেন মানুষের মুক্তির প্রত্যাশায়।
২০২০ সাল, অনুভূতির তীব্রতায় এলো এতো সেই মহামানবের জন্মশতবর্ষ। "১৭ মার্চ ২০২০ থেকে শুরু হয়ে ২৬ মার্চ ২০২০" ইতিহাসের দায় মোচনের কাল আমাদের। আমাদের হৃদয় থেকে উৎসারিত পরিস্ফুট আনন্দ কাল এই সময়টি। পৃথিবীর মহাঅসুখে আমরা কিছুটা সংবরণ করি মুজিববর্ষের আয়োজনে। কিন্তু ২০২১ সালের ১৭ থেকে ২৬ মার্চ আমাদের ভালোবাসা পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ভালোবাসার চিঠি উড়ে আসে মহান এই নেতার জন্মোৎসবে বার্তা হয়ে।দশ দিনের আয়োজনে তো পুরো বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরা সম্ভব নয় যার পরিব্যাপ্তি একটি মানুষের জীবনভর। তবুও আমরা নির্ধারণ করেছি 'মুজিব চিরন্তন'- কে সামনে রেখে দশটি প্রতিপাদ্য।
১৭ মার্চ- ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়
১৮ মার্চ- মহাকালের তর্জনী
১৯ মার্চ- যতকাল রবে পদ্মা যমুনা
২০ মার্চ-তারুণ্যের আলোক শিখা
২১ মার্চ-ধ্বংসস্তূপে জীবনের গান
২২ মার্চ- বাংলার মাটি আমার মাটি
২৩ মার্চ- নারী মুক্তি সাম্য ও স্বাধীনতা
২৪ মার্চ- শান্তি মুক্তি মানবতার অগ্রদূত
২৫ মার্চ- গণহত্যার কালরাত্রি
২৬ মার্চ- স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ও অগ্রগতির সুবর্ণরেখা।
প্রতিটি প্রতিপাদ্য কেবল যেন কোনো বিষয় নয়; এরসাথে জড়িত আছে গভীরে প্রোথিত বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ। ১৭ মার্চই এসেছে এক জ্যোতির্ময় আলো যে ভেঙেছে সমস্ত অন্ধকার তাঁর হাতেই নিবন্ধিত মহাকালের তর্জনী। যতকাল রবে এদেশের বুকে পদ্মা যমুনার জলধারা ততদিন তিনি মিশে থাকবেন আমাদের অস্তিত্বে। তিনিই তারুণ্যের আলোকশিখা, তিনি রচনা করেছেন ধ্বংসস্তূপে জীবনের জয়গান। এই বাংলার মাটিই তাঁর ঠিকানা ; চেয়েছেন অগ্রগামী নারী, উড়িয়েছেন শান্তি মুক্তি মানবতার পতাকা।গনহত্যার কালরাত্রি তিনি দেখেছেন আর ঘোষণা করে গেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
দশদিনের এ আয়োজন আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন আমাদের দেশের সাহিত্যিক শিক্ষক গবেষক রাজনীতিবিদ। আলোচনা করেছেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে। আমাদের আয়োজনে পৃথিবীর ষাটটি দেশ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য, বার্তা এবং অগুণতি ভালোবাসা পাঠিয়েছেন পৃথিবীর সবকটি মহাদেশেরই বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান সরকারপ্রধান এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রধান।
আঞ্চলিক সৌহার্দ্য আর শুভেচ্ছা নিয়ে মহামারীর এই সময়ে এসেছেন মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান এবং ভারতের রাষ্ট্র এবং সরকারপ্রধান। অসাধারণ সারল্যে তাঁরা প্রকাশ করেছেন আমাদের বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা। ভারতের সরকারপ্রধান নিয়ে এসেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য ভারতের অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার " গান্ধী শান্তি পুরস্কার ২০২০"। অনন্য এ আয়োজনে যুক্ত হয়েছিলেন তাঁরাও যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। ভারতের বিখ্যাত শিল্পী এ আর রহমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তৈরি করেছেন তার অনন্য সুর আয়োজন। সাংস্কৃতিক মেল বন্ধনে যুক্ত হয়েছে ভারত, জাপান, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, নেপাল সহ আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি।
পরে আয়োজনটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে গণমাধ্যমে। সবচেয়ে বড় প্রেরণা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা উপস্থিত থেকেছেন প্রতিদিন।
অনন্য আয়োজনে থেকে আমিও কালের সাক্ষী।
ভালোবাসা বঙ্গবন্ধু।
লেখিকা : স্নিগ্ধা বাউল- সহকারী পরিচালক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট