ড. কাজী এরতেজা হাসান
মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরে এসে ইদানিং একটি কথা জোরে শোরে বিভিন্ন মহল থেকে উঠছে কোন চাওয়া পাওয়া থেকে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেননি।
গত ২৭ মার্চ শনিবার জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কণ্ঠেও এই কথাটি শুনা গেছে। যার বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি। মুক্তিযুদ্ধে জীবনবাজি রেখে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা প্রান্তিক আয়ের মানুষ। কেন তারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন সে বিষয়ে নানা ধরনের কাহিনী গল্প ছড়িয়ে আছে বাংলার আনাচে-কানাচে।
এসব বীরদের বেশিরভাগই ছিলেন স্বল্প শিক্ষিত তবে দেশপ্রেমিক। যারা বঙ্গবন্ধুকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। জাতির জনকের একটি সহজাত গুণ ছিল। তিনি জনগণের মনের কথা পড়তে পারতেন। একই সঙ্গে ছিল সম্মোহনী ক্ষমতা। সহজেই মানুষের ভালোবাসা আদায় করে নিতে পারতেন। অনুরূপভাবে তিনিও সকলকে ভালোবাসতে পারতেন। যিনি একবার তার সান্নিধ্যে গিয়েছেন সারা জীবন বঙ্গবন্ধুকে তিনি মনে রেখেছেন।
তাই ১৯৭০ সালের পাকিস্তান রাষ্ট্রের একমাত্র সাধারণ নির্বাচনে তিনি অভূতপূর্ব সফলতা লাভ করেন। যার পেছনে জনগণের ভালোবাসা একই সঙ্গে তার উপর আস্থা কাজ করেছে। আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েই জাতি তার দায়িত্ব শেষ করেনি। তাইতো ১৯৭১ সালের মার্চে যখন বাঙালির আশা আকাক্সক্ষাকে টুটি চেপে হত্যা করা হয়, তখন বাঙালিরা রুখে দাঁড়ায়। নেতার ডাকের অপেক্ষা না করেই তারা রাস্তায় নেমে আসে।
এসময় তীর্থস্থান হয়ে ওঠে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর। লাখো লাখো জনতা জমায়েত হয়ে নেতার শেষ নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। নেতা যখন অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন বাঙালিরা তখন দ্বিধাহীন চিত্তে তা মেনে নেন। কোন রকম বেতার ঘোষণা ছাড়াই নিজ নিজ উদ্যোগে নেতার নির্দেশ দেশময় ছড়িয়ে দেয় সাধারণ মানুষ। তাইতো বাংলাবান্ধা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত নেতার আদেশ নির্দেশে সব কিছু চলতে থাকে। এসময় নেতার ভাষণের গুরুত্ব গ্রামের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে।
৭ মার্চ নেতার সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কয়েকটি চরণ.....আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের প্রতি আমার নির্দেশ রইলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। মনে রাইখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব এদেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’
এই কথা আর ভাষণ জিয়নকাঠি হিসাবে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকে কৃষক শ্রমিক মজদুর আর সাধারণ মানুষ প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। প্রস্তুতিটি হচ্ছে স্বাধীনতা। মুক্তি আর স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালিরা তখন থেকে দু’চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন আঁকতে শুরু করে। রক্তদান আর রক্তের ঢেউ সবই বাঙালির কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে। তাহলে স্পষ্ট হচ্ছে তাদের চাওয়া ছিল পাওয়ার লক্ষ্য ছিল। যদি চাওয়া এবং পাওয়ার লক্ষ্য না থাকত তাহলে স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনভাবেই সুসংগঠিত হতো না। হয়ে পড়তো বিছিন্নতাবাদী আন্দোলন। কিন্তু বাঙালি লক্ষ্য স্থির করেছিল বলেই শত অপপ্রচারের পরেও তা থেকে তারা বিচ্যুত হয়নি বা তাদেরকে বিচ্যুত করা যায়নি।
লক্ষ্য যখন স্থির থাকে তখন প্রত্যাশাও মনের কোনায় উঁকি মারে। আর সেদিনের সেই প্রত্যাশাই হচ্ছে আজকের স্বাধীনতা। স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। হাঁটি হাঁটি করে যার বয়স পঞ্চাশে পৌঁছেছে। সুতরাং যারা বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোন চাওয়া পাওয়া ছিল না তারা খণ্ডিত ভাবেই বলেন যা পূর্ণাঙ্গ নয়। তবে এখানে একটি কথা বলা যেতে পারে, এসময় রণাঙ্গনে যারা শত্রুর বিরুদ্ধে বুক চেতিয়ে লড়াই করেছেন, তারা অবশ্য নিজের স্ত্রী-পুত্র বাবা-মা বা পরিবারের প্রতি কোন একক সুবিধা পাওয়ার ভাবনায় করেননি। করেছেন সামষ্টিক অর্থে। দেশটা স্বাধীন হলে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে তার নিজের পরিবার পরিজনের ভাগ্য বদলাবে এই ভরসায় সেদিনের বীর মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছেন।
বর্তমান বাংলাদেশে অনেকেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারি সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এটি অস্বীকারের কোন পথ নেই। তাই বারবার সরকারকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নবায়ন, পরিবর্তন করতে হচ্ছে। তারপরেও থেমে নেই ভুয়াদের দৌরাত্ম। তাদের চাপে পড়ে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের নাম তালিকাভুক্ত করতে পারেননি।
এমন অনেক রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সরকারে দেওয়া কোন সাহায্য সহযোগিতা তারা পাচ্ছেন না। এর কারণও নিহিত রয়েছে, আর সেই কারণটি হচ্ছে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিনবছরের মাথায় এসে বাঙালির স্বপ্নকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কেবল তাঁকেই নয় তাঁর পরিবার এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীদেরও হত্যা করা হয়।
এই হত্যাকা- ধানমন্ডি ৩২ থেকে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মুজিব হলেন পরিতাজ্য এমনকি তার নাম নিলে জেল জরিমানার বিষয়টিকে সংযুক্ত করা হয়। রণাঙ্গনের সেই উজ্জীবিত স্লোগান ‘জয় বাংলা’ কে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সে স্থান দখল করে পাকিস্তানি ভাবধারার স্লোগান জিন্দাবাদ। ফলে সুবিধাভোগীরা নিজেদের স্বার্থে নতুন স্লোগানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকাশ্যে যে কাজটি করেন, সেটি হচ্ছে নিজেদের সকল স্বার্থ নিশ্চিত করা। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে তাই এই সেক্টরটিও তারা কুক্ষিগত করে। এসময় প্রয়োজন পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্লাটফর্মের। সেখানে হাজির করা হয় অনেক স্বাধীনতা বিরোধীদের। যাদেরকে বীর মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে অবৈধ সেনা শাসক তার নিজের পক্ষে কাজে লাগান।
এভাবেই বাঙালির জনযুদ্ধ একদিন বিভক্তরেখায় পরিণত হয়। যদিও সত্যের ঢাক আপনি বাজে, প্রচলিত প্রবাদটি আজ সামনে এসেছে। কিন্তু তার জন্য সময় পেরিয়ে যায় ২১ বছর। যার খেসারত দিচ্ছে বাঙালি। তাই আমরা মনে করি বৃহত্তম লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছেন। তবে একথা সত্যি নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে সেদিন তারা শত্রুর বুলেটের সামনে বুক পেতে দেননি।