১৯৭১
সালে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে
নেওয়া হয়েছে ৩০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্যোগ। এই স্বাক্ষর জাতিসংঘ থেকে
শুরু করে পাঠানো হবে বন্ধু দেশগুলোর কাছেও। এই উদ্যোগের শুরু হবে আগামী ১
এপ্রিল জাতীয় সংসদের অধিবেশনে। এই উদ্যোগ নিয়েছে একাত্তরের ঘাতক-দালাল
নির্মূল কমিটি।
সংগঠনটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগেও এখন
কেন যেন ভাটা পড়ে গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও যেভাবে উৎসবের সঙ্গে শুরু
হয়েছিল, এখন তেমন গতি নেই। তাই আমরা এবার ৩০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্যোগ
নিয়েছি। জাতীয় সংসদের সদস্যদের দিয়ে ১ এপ্রিল এই কার্যক্রম শুরু হবে। শুধু
দেশের নয়, বিদেশেও যারা আমাদের বন্ধু আছেন, তারাও এখানে স্বাক্ষর করবেন।
এরপর এই স্বাক্ষরগুলো আমরা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে পাঠাব।
আসলে এত বছর পর গণহত্যার স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব, কিন্তু কঠিন। এই কারণে আমরা
আগে জনমত গঠনের কাজে নেমেছি।
আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বহুবার বলেছি,
বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে চিঠি পাঠাতে। কিন্তু কেন তারা পাঠায়নি, আমরা জানি
না। এমনকি ভারতের কাছেও চিঠি পাঠায়নি। তাহলে তারা তো আগে স্বীকৃতি দিত? ৯০
বছর পর আর্মেনিয়া গণহত্যার স্বীকৃতি পেয়েছে। সেখানে সরকার ও জনগণ একসঙ্গে
কাজ করেছে। এখানেও যদি আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তাহলে গণহত্যার
স্বীকৃতি আদায় সম্ভব।’
৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সশস্ত্র
বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে নিরীহ বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১৬
ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত নয় মাস ধরে এই গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ
চলে। যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে এবং দুই লাখ নারী ও
মেয়ে শিশুর ওপর যৌন সহিংসতা চালায়। তবে ২৫ মার্চ রাতে যে গণহত্যা, সেটার
এখন আর স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন শাহরিয়ার কবীর।
কারণ হিসেবে
তিনি বলেন, ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি
দিয়েছে। ১৯৬টি দেশ সেখানে সই করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে। ফলে এখন আর
বলার সুযোগ নেই যে, আমরা এটা মানি না। তাই আমাদের এখন ৯ মাসের যুদ্ধে যে ৩০
লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে সেটার স্বীকৃতি পেতে হবে। অনেক বড় দেশই এটার
বিরোধিতা করবে তারপরও এটা আদায় করা সম্ভব। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন তো তখন
পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, ফলে তারা চাইবে না।
গণহত্যার স্বীকৃতির ক্ষেত্রে
আন্তর্জাতিক মানবতা অভিশাপগ্রস্ত কি না সে প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশ মানবাধিকার
কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘এটা আন্তর্জাতিক
অপরাধ। এর স্বীকৃতি হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবেই। কারণ, এখানে আন্তর্জাতিক আইন
লঙ্ঘিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ অনেক দেশই তো তখন পাকিস্তানের পক্ষে
ছিল। আমরা তো দেখেছি, একাত্তরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত যে তারবার্তা
পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে সেখানে গণহত্যার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
তারপরও নিক্সন সেদিকে কর্ণপাত করেননি। তিনি পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে গেছেন।
ফলে তারা চাইবে না এটার স্বীকৃতি হোক। যেমন যুদ্ধাপরাধের বিচারেও
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে আসেনি। বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে
যুদ্ধাপরাধের বিচার করেছে। এটা তো যারা স্থানীয় অপরাধী তাদের বিচার করা
গেছে। কিন্তু যারা গণহত্যা চালিয়েছে, তারা তো পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে এখন
অবস্থান করছেন। তাদের তো বিচার হতে হবে। এমনকী তাদের মরণোত্তর বিচার করাও
সম্ভব। তা না হলে আইনি ন্যায্যতা আসবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার
ফর জেনোসাইড স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক ও প্রবীণ সাংবাদিক অজয়
দাশগুপ্ত বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ
ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এই গণহত্যার শিকার হওয়া মানুষের লাশ দেখেছি।
মাটিচাপা দেওয়ার পরও দেখা গেছে, কারো হাত কারো পা বের হয়ে আছে। যুদ্ধে
আমাদের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
এটা কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
পর আর কখনো হয়নি। যেসব দেশে গণহত্যা হয়েছে, সেখানে কিন্তু একটা দেশের সঙ্গে
আরেকটা দেশের যুদ্ধ হয়েছে। আমাদের এখানে কিন্তু শান্তিপূর্ণ নিরীহ মানুষের
ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। পাল্টা হিসেবে আমরা যুদ্ধ শুরু করি। এটার
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না হওয়ার একটা বড় কারণ মনে হয়, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে
বিধ্বস্ত একটি দেশ, অর্থনৈতিক পুনর্গঠনসহ এই কাজগুলোতে বেশি মনোযোগ দিয়েছি।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন তো অস্ত্র দিয়ে এই গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে। ফ্রান্স,
বৃটেনসহ আরও অনেক দেশই তখন সরাসরি এই গণহত্যার বিরোধিতা করেনি।
এই কারণে
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের অবস্থানটা খুব জোরালো ছিল না। এখনও এটার সময়
যায়নি। এটার স্বীকৃতি পেতে হলে দালিলিক প্রমাণ দিতে হয়। সেগুলো নিয়ে কাজ
হচ্ছে। আমার মনে হয় সবাই মিলে কাজগুলো করতে পারলে এটার স্বীকৃতি পাওয়া
যাবে।’