ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গত তিনদিন ধরে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব ও নৈরাজ্যের নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। এমনকি একটি ভিনদেশী গোয়েন্দা সংস্থা নিয়েও প্রপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ এই বিএনপি নেত্রীর বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হেফাজতে ইসলামের হরতাল পালনকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন সর্বত্র। পোড়া গন্ধে মোহিত চারদিক। ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে সরকারি, বেসরকারি অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান, দু’টি মন্দির, আওয়ামী লীগ ও জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের বাড়িতে। রক্ষা পায়নি পুলিশের কার্যালয়। এসব ধ্বংসলীলা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে গোপনে নিজের নেতাকর্মীদের দিয়ে হেফাজতের লোকজনকে উসকানি দিয়েছেন এই রুমিন ফারহানা। বিষয়টি হেফাজতের লোকজনই স্বীকার করেছে।
পুলিশের হাতে আটক ব্রাহ্মণবাড়িয়া একাধিক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বলেছেন, বিএনপির এই বিতর্কিত এমপির নির্দেশনাতেই তারা মাঠে নেমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। কারণ তাদের হুজুররা এমনটাই বলেছেন।
এর আগে মোদী বিরোধী আন্দোলনে হাটহাজারি এবং রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদে হামলার ঘটনার প্রতিবাদের (২৬ মার্চ) শুক্রবার পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এর পরের দিন (২৭ মার্চ) শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শহর এবং নন্দনপুরে পৃথক ঘটনায় ৬ জন নিহত হয়। এ ঘটনার জের ধরে দেশব্যাপী হরতাল আহবান করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
হরতালের শুরুতে রোববার (২৮ মার্চ) সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা সাজেদুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল বেরহয়। মিছিলটি শহরের প্রধান-প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে জামিয়া ইউনুছিয়ার সামনে গিয়ে শেষ হয়।
এসময় হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা সাজেদুল ইসলাম বলেন, কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই শনিবার (২৭ মার্চ) বিকেলে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়ায় হামলা করে অজ্ঞাত কিছু মানুষ। পরে আত্মরক্ষার্থে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। এ প্রতিরোধে ৮ জন কর্মী শহীদ হয়েছেন বলেও তিনি দাবি করেন।
এদিকে বেলা বাড়ার সাথে সকাল ১০টার পর থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাকে করে প্যান্টশার্ট পরিহিত কয়েকশত শিবির কর্মী লাঠি সোটা নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। এরপর শুরু হয় শহরজুড়ে তাণ্ডব। এই শিবিরকর্মীদের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন রুমিন ফারহানা।
প্রথমে ঢাকা-থেকে চট্টগ্রামগামী সোনার ট্রেনে নরসিংহসার এলাকায় যৌথ হামলা করে হেফাজত ও জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এরপর শহরের জেলা পরিষদ ভবন আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। পরে একে এক পৌরসভা ভবন, শহর মিলনায়তন, শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ভাষা চত্তরের উন্নয়ন মেলা, আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, মুক্তিযোদ্ধা ভবন, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, জেলা সরকারি গ্রন্থাগার, পানি উন্নয়ন বোর্ড, খাটি হাতা হাইওয়ে থানা ও আশুগঞ্জ টোল প্লাজা পুড়িয়ে দেয়া হয়। একই সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের অফিস এবং বাসভবন পুড়িয়ে দেয়া হয়। হামলা চলাকালে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বাসভবন জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
হেফাজত তাণ্ডব চলাকালে ভাংচুর করা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রধান মন্দির। আনন্দময়ী কালী বাড়ীতে হামলা ভাংচুর করা হয়। এছাড়া পুলিশ লাইন, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিস, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, জেলা শিল্পকলা একাডেমী, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় হামলা করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পুরো শহরজুড়ে তাণ্ডব চলে। এসময় শহরজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাউকে দেখা যায়নি।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বাহিরে শহর বাইপাস পৈরতলা এবং পীরবাড়ী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে দুইজন নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় অন্তত অর্ধশত আহত হয়। আহতদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামিসহ ২৭ জনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা: শওকত হোসেন জানান, ২ জনকে আমরা নিহত অবস্থায় পেয়েছি। এছাড়া ২৭ জনকে চিকিৎসা দিয়েছি। আমাদের হাসপাতালের সদস্যরা বিরামহীনভাবে কাজ করছে।
হাসপাতালে তথ্য অনুযায়ী গত ২৬ মার্চ নিহত হয় ওয়ার্কশপ কর্মী শহরের দাতিয়া এলাকার আশিক (২৪)। গতকাল ২৭মার্চ সদর উপজেলার নন্দনপুরে সংঘর্ষে নিহত হয় ৬জন। নিহতরা হলেন, বাদে হারিয়া গ্রামের আব্দুল লতিফ মিয়ার ছেলে ওয়ার্কশপের দোকানদার জুরু আলম (৩৫), সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার দাবিড় মিয়ার ছেলে শ্রমিক বাদল মিয়া (২৪) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারিউড়া মৈন্দ গ্রামের জুরু আলীর ছেলে সুজন মিয়া (২২), জুবায়ের (১৪), নন্দপুর গ্রামের মাদুমিয়ার পুত্র নূরুর আমিন এবং বুধলের আলী আহমদের ছেলে প্লাষ্টিক শ্রমিক কাউসার (২৫)।
এদিকে রোববার (২৮ মার্চ) শহরতলীর পৈরতলা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে শহরের খৈয়াসার এলাকার অজ্ঞাত এক যুবক (২২) নিহত হয়। অন্যদিকে সরাইল বিশ্ব রোড এলাকায় আইনশৃঙ্খলবা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে সদর উপজেলার ঘাটুরা গ্রামের সফিউদ্দিনের ছেলে আল আমীন (১৯) নিহত হয়। সব মিলিয়ে গত তিন দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৯ জন নিহত হয়েছে।
সূত্র বলছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের আড়ালে নারকীয় তাণ্ডব চালায় স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত চক্র। গত শুক্রবার শহরজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় হেফাজতে ইসলাম। এরপর মাদ্রাসা ছাত্রদের আড়ালে শনিবার জেলাজুড়ে মাঠে নামে শিবির-ছাত্রদলের প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীরা। তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে কাজ করছেন বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা।
ভোরের পাতা/কে