#বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ থেকে মৌলবাদীদের চিরতরে নির্মূল করতে হবে: ড. শাহিনূর রহমান। #সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ফের ধর্মান্ধের বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে: আহমেদ ফিরোজ। #মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উগ্র মৌলবাদীদের রুখে দিতে হবে: সাজ্জাদ আলম খান তপু।
শেখ মুজিবের সোনার বাঙলাকে নিয়ে ফের ষড়যন্ত্র শুরু করেছে সেই পাকিস্তানের রয়ে যাওয়া কিছু প্রেতাত্মারা যারা আজ হেফাজত, জামায়াত-শিবির নামে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজকে সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীরা আবারো ফণা তুলছে। কিন্তু তারা বাঙালির আসল চেহারা এখনো দেখেনি। বাঙালি যদি ফণা তুলে দাঁড়ায় তাহলে তারা এবার আর রক্ষা পাবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের ঐক্য অবস্থানই পারে এই ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ২৯২তম পর্বে রোববার আলোচক হিসাবে উপস্থিত হয়ে এসব কথা বলেন- ইসলমী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহিনূর রহমান, অস্ট্রিয়া প্রবাসী ও আন্তর্জাতিক বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের মহাসচিব আহমেদ ফিরোজ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু। দৈনিক ভোরের পাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভোরের পাতার সিনিয়র রিপোর্টার উৎপল দাস।
অধ্যাপক ড. শাহিনূর রহমান বলেন, আমি আমার বক্তব্যের শুরুতে গভীর শ্রদ্ধা জানাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যে মহামানবের অবদানে আজ আমরা লাল সবুজের পতাকা নিয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করা দাঁড়িয়ে আছি, গভীর শ্রদ্ধা সাথে স্মরণ করছি ১৫ আগস্টের সেই কালো রাতে তার পরিবারের যেসব সদস্যরা শাহাদাতবরণ করেছিলেন। গভীর শ্রদ্ধা সাথে স্মরণ করছি ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ ইজ্জতহারা মা-বোনদের। গভীরভাবে স্মরণ করি জাতীয় ৪ নেতাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালির স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি আমরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রামকে তার কালজয়ী নেতৃত্বে ১৯৭১-এর মার্চে চূড়ান্ত পরিণতিতে নিয়ে আসেন। তিনি পূর্ব বাংলায় সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ করে পাকিস্তানি মৌলবাদী গোষ্ঠীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল এবং তাদের কাছ থেকে আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হন তিনি। আমাদের মাতৃভূমি বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু, দিতে হয়েছে লাখ প্রাণের তাজা রক্ত। পাকিস্তানি শাসনের শৃঙ্খল থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার সেই গৌরব ও অহংকারের দিন ২৬ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, ধ্বংস ও পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে ৯ মাসের মরণপণ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের, জন্ম হয় লাল-সবুজ পতাকার। সেই ’৪৮ সাল থেকে শুরু করে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তদান সংগ্রাম-আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জাতির রায়, ’৫৬-তে এসে সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায়, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফার মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তিসনদ ঘোষণা, ’৬৯-এর ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিদায় এবং ’৭০-এ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়ের ধারাবাহিকতায়ই এসেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং স্বপ্নের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে স্বল্পোন্নত এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের তথা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করেছে। এই সময়ে বাংলাদেশ ৯০ ডলারের মাথাপিছু আয় থেকে ২০৬২ ডলারের মাথাপিছু আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। প্রবৃদ্ধিও ঠিক একইভাবে ৬-৭% ঘরে উন্নীত হওয়ার ধারা বজায় রাখতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের অনুভূতি ও অন্তরাত্মায় মিশে আছেন। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। আজকের এই সোনার বাঙলাকে নিয়ে ফের ষড়যন্ত্র শুরু করেছে সেই পাকিস্তানের রয়ে যাওয়া কিছু প্রেতাত্মারা যারা আজ হেফাজত, জামায়াত-শিবির নামে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখনি সময় হয়ে এদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে এদের মূল উৎপাটন করা। আমাদের অন্যতম শক্তি হলো একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমি বিশ্বাস করি এই চেতনায় আমরা সবাই বিশ্বাসী হলে বাংলাদেশে এসব মৌলবাদ ঠাঁই পাবে না।
আহমেদ ফিরোজ বলেন, বাঙালি জাতির সৌভাগ্য শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন অসাধারণ নেতা পেয়েছিল। সাহস-শৌর্য-বীর্য-দূরদর্শিতা, যোগ্যতা, দেশপ্রেমে যার কোনো তুলনা হয় না। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে নির্বাচনে রূপকল্প-২০২১ প্রদান করেন। এতে তিনি বিদ্যুৎ, ডিজিটালাইজেশন, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবহাওয়া, যোগাযোগ, রেমিট্যান্স ইত্যাদি খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। ২০২১ সালকে তিনি বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরেই শেখ হাসিনার সরকার বিদ্যুতের ব্যাপক ঘাটতি মোকাবিলায় ছোট মাঝারি ও বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দেন। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার পর অনেক দেশই আশঙ্কা করেছিল ঘনবসতির এই দেশ করোনা সংক্রমণের অভিঘাত সহজে মোকাবিলা করতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ সেই অভিঘাত অনেকটাই মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। পারিবারিক ভাবে বঙ্গবন্ধু ইসলামি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পরিবার এবং বাবার মতো ইসলাম ধর্ম পালন এবং ইসলামি অনুসারীদের সহায়তা করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু ইসলাম ধর্ম পালন করলেও অন্য ধর্মের প্রতি ছিলেন সমান শ্রদ্ধাশীল। তিনি কোনোদিন অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি এবং ভিন্ন ধর্মের প্রতি কোনোরূপ বিরুদ্ধতা করেননি বরং তাদের সহায়তা করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রধান রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে তা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো নয়। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কথাটা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। এটা বঙ্গবন্ধু নিজেই দিয়ে গিয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তারা তাদের ধর্ম পালন করবে, হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে। খৃস্টান তাদের ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধ তাদের নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের ব্যবসা চলবে না, ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না।’ আজকে সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আবারো ফণা তুলছে। কিন্তু তারা কিন্তু বাঙালির আসল চেহারা এখনো দেখেনি। আমরা যদি ফণা তুলে দাড়ায় তাহলে কিন্তু তারা এবার আর রক্ষা পাবে না।
সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, বাংলাদেশে আসলে কারা ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দিচ্ছে? এরা কারা? আমাদের আসলে এটা খুঁজে বের করতে হবে। আমরা এদের হাটহাজারিতে দেখেছি, আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে দেখছি। এদের যতই মুখোশ থাকুক না কেন আমরা কিন্তু বুঝি এরা কারা। শান্তি প্রিয় ধর্ম ইসলামকে এরা রাজনৈতিক আঁকারে নিয়ে উচ্ছৃঙ্খলতা উন্মাদনা ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। আমরা দেখেছি ‘৭৫-এ রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার মাধ্যমে এই উন্মাদনা সে সময় কিছুটা বেগ পেয়েছিল। দীর্ঘ ২১ বছর আমরা এর কাল সাক্ষী ছিলাম। এই ২১ বছর তারা এই ধর্মীয় উন্মাদনা কাজে লাগিয়ে তাদের শাসন শোষণের পক্রিয়াটাকে পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তাদের আসল উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারেনি কারণ বাঙলার মানুষ বীরের জাতি, যে জাতির আদর্শিক পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরা সব সময় মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েও তাদের মূল আকাঙ্খা বাস্তবায়ন করতে পারেনি কখনো। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আমরা মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশ থেকে এগিয়ে। করোনাকালে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশ তাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারেনি। বাংলাদেশ পেরেছে এবং সেটা অন্যদের কাছে বলছে, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এ স্মরণীয় বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যারা অতিথি হয়ে এসেছেন তারা সবাই বলছেন বাংলাদেশের এ অর্জনের কথা। এই স্বনির্ভর বাংলাদেশকে নিয়ে এই উগ্রমৌলবাদীরা ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠার পাঁয়তারা করছে। আমরা যখন আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি তখন আবার এই উগ্রধর্মীয় গস্টিদের আস্ফালন আবার বেড়ে গিয়েছে। এই জন্য আমাদের সদা জাগ্রত থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের ঐক্য অবস্থায় পারে এই ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।