ড. কাজী এরতেজা হাসান
গত ১৭ মার্চে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় করোনা ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকার হাসপাতালগুলো অগ্নিঝুঁকির বিষয়টি ফের সামনে এসেছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে একাধিক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এতে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে। অনাকাক্সিক্ষত এই ঘটনা কেন ঘটল এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে, কাদের গাফিলতি ও অবহেলায় অগ্নিকাণ্ডের মতো দুঃখজনক ঘটনা তার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত এবং দায়ীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
প্রশ্ন হলো রাজধানীসহ ঢাকার অসংখ্য হাসপাতাল ও ক্লিনিক অগ্নিঝুঁকির বিষয়টি মোটেই আনন্দের খবর নয়। এটি দারুণ আতঙ্ক ও উদ্বেগের খবর। রাজধানীসহ ঢাকার যেসব হাসপাতাল এবং ক্লিনিক অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে, অতিসত্বর এই অগ্নিঝুঁকি কীভাবে কমিয়ে আনা যায় তার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। গতকাল দৈনিক ভোরের পাতায় ‘অগ্নিঝুঁকিতে ঢাকার হাসপাতাল’ শিনোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছরে ৯০টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আগুন লাগে। ২০১৯ সালে শুধু ঢামেকসহ রাজধানীর ২০টির মতো সরকারি হাসাপাতালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসাপাতালে আগুন লেগে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মতো জায়গা অগ্নিঝুঁকিতে থাকাটা কতটা বেমানান তা বোধকরি সবাই বুঝবে। মানুষ সুস্থ হওয়ার জন্য হাসাপাতাল-ক্লিনিকে যান, আর সেটিই যদি অগ্নিঝুঁকিতে থাকে, তাহলে মোটা দাগে প্রশ্ন ওঠে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কোন কাজটি করেন।
জানা গেছে, রাজধানীসহ ঢাকার ৪২৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে ৪১৬টি। এর মধ্যে ১০৫টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৩১১টি অল্প ঝুঁকিপূর্ণ। অগ্নিঝুঁকি এড়াতে জলাধার, ভবনের ধারণ সক্ষমতা, হিট ডিটেক্টর, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফটসহ যেসব বিষয় থাকা বাঞ্ছনীয় তা অধিকাংশ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নেই। অগ্নিঝুঁকির ক্ষেত্রে সন্তোষজনক ব্যবস্থাপনা রয়েছে মাত্র সাতটি হাসপাতাল-ক্লিনিকে। ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ৪২৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিদর্শন শেষে এমনই প্রতিবেদন দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিঝুঁকিতে থাকা হাসপাতালগুলোতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অগ্নিঝুঁকি হ্রাসে কিছু পরামর্শও দেওয়া হয়। কিন্তু সেসব পরামর্শের কোনোটিই আমলে নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ঘটে যায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও সোহরাওয়ার্দীর মতো অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এরকম প্রতিবেদন বেশ আগেই দেওয়া হয়েছিল। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোহরাওয়ার্দী হাসাপাতালে আগুন লাগে। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১৭ মার্চ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। একটি সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে ঢাকাকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে সব ধরনের স্থাপনা পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয় ফায়ার সার্ভিস। শুরুতে ঢাকার ৪৩৩টি হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং বছর শেষে ৪২৩টি হাসপাতাল-ক্লিনিক পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনে মাটির নিচের জলাধারের ধারণ ক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, স্মোক/হিট ডিটেক্টর, মেঝের আয়তন, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফট ইত্যাদি বিষয় খতিয়ে দেখে ঝুঁকি নিরূপণ করা হয়। ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিদর্শন করে ৪৩৩টির মধ্যে ১৭৩টিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ২৪৯টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
তবে মাত্র ১১টি হাসপাতাল-ক্লিনিককে অগ্নিনিরাপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ওই একই বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ৪২৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিদর্শন শেষে ১০৫টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৩১১টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস। ওই পরিদর্শন প্রতিবেদনে মাত্র সাতটিকে সন্তোষজনক হিসেবে দেখানো হয়।
১৭ মার্চ ঢামেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রমাণ করেছে রাজধানীর সবচেয়ে বড় হাসপাতালটিতে যদি অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে, তাহলে রাজধানীসহ অন্য সরকারি হাসপাতাল কতটা অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে সহজেই বোধগম্য। আর একটি বিষয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আগুন লাগার ঘটনা কোনোভাবেই ছোট কোনো দুর্ঘটনা নয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, মারা যাওয়া তিন রোগী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাননি, মারা গেছেন স্থানান্তরের সময়। এ কথা সত্য বলে ধরে নিলেও তিন রোগীর মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ নিশ্চয়ই আগুন। আগুন না লাগলে তো তাদের স্থানান্তরের প্রশ্ন উঠত না।
আমাদের কথা হচ্ছে, আগুন কীভাবে লাগল, তার তদন্ত হওয়া উচিত এবং সেই তদন্তে কারও গাফিলতি অথবা দায়িত্বে অবহেলা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে নেওয়া উচিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। এত বড় একটি হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ধরনের ঘাটতি কাম্য নয়। হাসপাতালে রোগীরা যান চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার জন্য। সেখানে যদি তারা কোনো দুর্ঘটনায় মারা যান, তা মেনে নেওয়া যায় না। দেশে করোনা পরিস্থিতি আবারও খারাপ অবস্থায় চলে গেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে চলেছে প্রতিদিন।
এ অবস্থায় দেশের হাসপাতালগুলোয় রোগীদের চাপ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, হাসপাতালগুলোয় দেখা দিয়েছে আইসিইউ সংকট। রোগী ভর্তির এই বাড়তি চাপের সময় প্রতিটি হাসপাতালেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। লক্ষ করার বিষয়, করোনাকালীন যে দুটি হাসপাতালে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে, তার দুটোতেই আগুন লেগেছে করোনা ইউনিটে।
পরিশেষে বলতে চাই যে, দেশের হাসপাতালগুলোয় করোনা ইউনিটে বাড়তি সতর্কতা বজায় রাখার কথা বলতে চাই আমরা। তবে শুধু আগুন নয়, হাসপাতালগুলোয় কোনো ধরনের দুর্ঘটনাই যাতে ঘটতে না পারে, সেদিকে কর্তৃপক্ষগুলোর সজাগ দৃষ্টি থাকা একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি সরকারকে ভেবে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে।