শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪ ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিরোনাম: বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে সুইজারল্যান্ড বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন: তাজুল ইসলাম   ইংরেজি নববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা   করোনায় মৃত্যু কমেছে, শনাক্ত বেড়েছে    আরও ৩ জনের ওমিক্রন শনাক্ত   শপথ নিলেন নতুন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী   বাস সরাতে গিয়ে দুই মৃত্যু: সেই পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা   আন্দোলনের বিকল্প নেই, ফয়সালা রাজপথেই হবে: ফখরুল   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
ক্যানসার হাসপাতালে রোগীদের নিরব কান্না
শাকিল আহমেদ
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৩ মার্চ, ২০২১, ১২:০০ এএম আপডেট: ২৩.০৩.২০২১ ১২:৩৬ এএম | প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালে কান পাতলেই শোনা যায় রোগী ও তার স্বজনদের নিরব কান্না। গরিব ক্যানসার রোগীদের একমাত্র ভরসা মহাখালির জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। কিন্তু সেখানেও মিলছে না কাক্সিক্ষত সেবা।

হাসপাতালটির ধারণ ক্ষমতার চেয়ে রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় প্রয়োজনীয় সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। সিট না থাকায় হাসপাতালে বাড়ছে ভর্তি বিড়ম্বনা। এদিকে ঢাকায় থেকে রোগীর চিকিৎসা করা, থাকা-খাওয়া এবং ওষুধ কেনা খরচ বহন করতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন। প্রিয় মানুষকে বাঁচাতে সবকিছু বিক্রি করে দিচ্ছেন কেউ কেউ। এরপরও দেখছেন, না বেঁচে ফেরার কোনো আশার আলো। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী  মুশতাক হোসেন।

বাংলাদেশে ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। কিন্তু বাংলাদেশে ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যবস্থা যা আছে, তা একদিকে অপ্রতুল এবং অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদে অনেক ব্যয়বহুল। ক্যানসার নিয়ে গবেষণাকারী একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

এছাড়াও প্রতিবছর আরও প্রায় দেড় লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। এই রোগের চিকিৎসা সেবা মূলত ঢাকা কেন্দ্রিক। কিন্তু ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় একটি বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি। ঢাকার বাইরে মাত্র দু’টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সীমিত আকারে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান নেই। এর কোনো উদ্যোগ কখনও নেওয়া হয়নি। ২০০৯ সালে ক্যানসার প্রতিরোধে একটা নীতিমালা করা হয়েছিল যেটা আর হালনাগাদ করা হয়নি। সেই নীতিমালা অনুসরণ করেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেটা বলা যায় না। এরজন্য সবার আগে দরকার নিজস্ব পরিসংখ্যান।

রোগীর সংখ্যা কত? কি ধরনের ক্যানসার বেশি হচ্ছে, এগুলো যদি জানা না যায়, তাহলে সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে দিশেহারা রোগীরা। আক্রান্তদের অনেকে বলেছেন, চিকিৎসা ব্যয় সামলাতে গিয়ে জমিজমা বিক্রি করে পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। মহাখালী জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ৫২০ শয্যার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ রোগীই নিম্নআয়ের পরিবার থেকে আসা।

সেখানে রোগীদের কয়েকজন বলেছেন, বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় সরকারি এই হাসপাতালে খরচ কিছুটা কম। কিন্তু লম্বা সময় ধরে সেটাও সামাল দিতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ক্যানসারে আক্রান্ত একজন নারী বলেছেন, সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা পাওয়ার জন্যও তাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।

১৮ মার্চ ক্যানসার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, দ্বিতীয় তলার মেঝেতে শুয়ে আছে দিনমজুর জীবন মার্দি, তার মাথার কাছে বসে আছে  স্ত্রী জয়ন্তী সরেন।

জয়ন্তী সরেন ভোরের পাতাকে বলেন, ‘আমরা ঢাকার বাইরে থেকে আসছি। আমাদের বাড়ি নওগাঁর সাপাহার। আমার স্বামী গত একবছর ধরে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত। এতদিন রাজশাহীতে চিকিৎসা নিয়েছি কোন উন্নতি হয়নি। তাই ওখানের ডাক্তাররা ঢাকায় আসতে বলছে। গত ৯দিন হলো এই হাসপাতালে আসছি, এরপর থেকে এখানেই পড়ে আছি এখনো ভর্তি করাতে পারিনি। ডাক্তাররা অনেকগুলো টেস্ট দিয়েছে সেগুলো করেছি। ইমারজেন্সি থেকে মাঝে মাঝে ফ্রি ওষুধ দেয় এছাড়া সব নিজেদের কিনে নিতে হয়। শুনছি টাকা-পয়সা দিলে আগে ভর্তি হওয়া যায়, হাসপাতাল থেকে ফ্রি খাবার পাওয়া যায়। আমরা গরিব মানুষ এখানে আমাদের কোন লোকজন নেই, টাকা পয়সা নেই কবে ভর্তি নিবে তাও জানি না।’

হাসপাতালের তৃতীয় তলায় একটি পিলারের পাশে ফাইল হাতে নিয়ে মন খারাপ করে বসে ছিলেন শাহিনুর বেগম (৩৫)। তার বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে, দুই বছর ধরে ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত রয়েছে একমাত্র ছেলে আবু রায়হান (৫)। তার স্বামী আব্দুল করিম পেশায় ভ্রাম্যমাণ পান-সিগারেট বিক্রেতা।

শাহিনুর বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে ক্যানসারে আক্রান্ত। আত্মীয় স্বজনের পরামর্শে সবকিছু বিক্রি করে বেসরকারি (ডেন্টাল কেয়ার হাসপাতাল ও জাহানারা মেডিকেল) হাসপাতালে এতদিন ছেলের চিকিৎসা করাইছি। কোন উন্নতি হয়নি, সবকিছু বিক্রি করে এখন আমি নিঃস্ব। গত চারমাস ধরে এই হাসপাতালে আছি, এখন আর খরচ চালাতে পারছি না। আমাদের কোন লোকজন নেই, টাকা পয়সা নেই এখনো ভর্তি করতে পারিনি। আমার স্বামী আমাদের সাথে থাকায় তার আয় রোজগার বন্ধ। কি করবো বুঝতে পারছি না।’

এসময় মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে দুষ্টুমি করছে পাঁচ বছরের অবুঝ শিশু আবু-রায়হান। সে হয়তো জানেও না তার শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যানসার। হাসপাতালের ৫ম তলায় রয়েছে রোগীদের বেড। ডানপাশে লেখা রয়েছে ‘১নং মহিলা ওয়ার্ড’ ভাড়া বেড। এখানে প্রতিটি বেড ২৮২ টাকা মূল্যে রোগীদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। চাঁদপুর ফরিদগঞ্জ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রেস্ট ক্যানসার নিয়ে ভর্তি হন পারভিন আক্তার (৩০)। সাথে আছে তার ছোট ভাই মো. তোয়ামিন (২০)।

তোয়ামিন এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার বোন ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত। সে অসুস্থ হলে তার স্বামী তাকে ফেলে চলে যায়। ২৮ ফ্রেব্রুয়ারি এখানে তাকে ভর্তি করাই। এরপর ১৩ মার্চ প্রতিদিন ২৮২ টাকায় ভাড়া একটি সিট পেয়েছি। তাও অনেক কষ্ট করে। এখানে ভর্তি হতে ১৪৭০ টাকা লাগে। খাবারের মানও ভালো না, তাই তিন বেলা বাইরে থেকে কিনে খেতে হয়। এদিকে ওষুধের দাম এবং থেরাপি চার্জ তো আছেই। সবমিলিয়ে আমরা খুব দিশেহারা।’

৫ম তলার  বাম পাশে লেখা রয়েছে ‘মহিলা ওয়ার্ড-২’ ভাড়া ছাড়া সিট। সেখানে কথা হয় শরিয়তপুরের কবিরের সাথে। কবির এ প্রতিবেদককে বলেন, দুই বছর ধরে আমার মায়ের ডান পায়ে ক্যানসার হয়েছে। কিছুদিন ভালো থাকলেও থেরাপি দিতে না পারলে আবার বেড়ে যায়।

গত পাঁচ দিনে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে শুধু ক্যামো থেরাপি দিতে। অন্যান্য খরচতো আছেই। এখানে  ৮দিন ধরে আছি এর আগেও মা দুইবার ভর্তি ছিলো। ফ্রি সিট লেখা থাকলেও দুই থেকে তিন হাজার টাকা লাগে এখানে সিট পেতে। দ্রুতই চলে যাবো। এখানে থাকতে অনেক খরচ এবং কষ্ট হয়।’ হাসপাতালের ছয় তলায় একই অবস্থা। সেখানে পুরুষ ওয়ার্ড একপাশে ভাড়া সিট অন্যপাশে ভাড়া ছাড়া।

উল্লেখ্য, ক্যানসার রোগীদের স্বল্প মূল্যে উন্নতমানের চিকিৎসা দেবার লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ১১ আগস্ট যাত্রা শুরু করে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এখানে ইনস্টিটিউট এবং হাসপাতাল দুইটি আলাদা ভবনে অবস্থিত। প্রত্যেকটি ভবন তিনটি ব্লকে বিভক্ত। এখানে আইসিইউ এবং ব্লাড ব্যাংক রয়েছে। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা ৩০ মিনিট থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বহির্বিভাগে রোগী দেখা হয়। টিকিটের মূল্য ১০টাকা।

এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য সর্বপ্রথম  রোগীকে সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধান কেন্দ্রে খোঁজ নিতে হয়। সেখান থেকে পনের টাকা দামের একটা ফরম পূরণ করে জরুরি বিভাগে মেডিকেল অফিসারকে দেখানো হয়। তার পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে ভর্তি করা হয়। মোট ৫২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল এটি। যাতে ৯টি ওয়ার্ড এবং ৩০টি কেবিন রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে এখানে ক্যানসার বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারী ৮ জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রয়েছেন। এছাড়াও এখানে মোট চিকিৎসক রয়েছেন ৮৫জন। এখানে ডাক্তাররা দুইটি আলাদা শিফটে সেবা দিয়ে থাকেন। প্রতি শিফটে একবারে ২৫ জন ডাক্তার ডিউটি করে থাকেন।

হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী মুশতাক হোসেন ভোরের পাতাকে বলেন, ‘ক্যানসার থেকে বাঁচতে হলে সচেতন হতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই। প্রাথমিক অবস্থায় (প্রথম ধাপে) চিকিৎসা নিলে একজন অসুস্থ ব্যক্তি পাঁচ বছর সুস্থ থাকার ৯০ ভাগ সম্ভাবনা থাকে। অর চতুর্থ ধাপে যদি সে চিকিৎসা নিতে আসে তাহলে সেই সম্ভাবনা ২০ ভাগে নেমে আসে। কিন্তু আমাদের দেশে রোগীরা সচেতন নন। তারা অসুস্থ হলে আগে নেয় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। এরপর রোগটা যখন বৃদ্ধি পেয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে চলে আসে তখন তারা আসে ক্যানসার হাসপাতালে। তখন আর আমাদের কিছু করার থাকে না। প্রথম ধাপে আসলে একটা রোগী পাঁচ বছর সুস্থ থাকার সম্ভাবনা থাকে ৯০ ভাগ, দ্বিতীয় ধাপে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ, তৃতীয় ধাপে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ এবং চতুর্থ ধাপে আসলে ১৫ থেকে ২০ ভাগ সম্ভাবনা থাকে। তাই ক্যানসারের বিষয়ে মানুষকে সচেতনতা করা খুবই জরুরি। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরতে পারলে টিকা দিয়ে ক্যানসার প্রতিরোধ করাও সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, আমাদের হাসপাতালে সিট আছে ৫০০টা। কিন্তু সারা দেশ থেকে রোগী আসে হাজার হাজার। একসাথে এত রোগীর চিকিৎসা দিতে গেলে কিছু বিড়ম্বনা তৈরি হয়। সেক্ষেত্র শুধু রোগীদেরই ভোগান্তি হয় না, আমাদেরও বাড়তি চাপ নিতে হয়। আমরা সব রোগীকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সেবা দিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।





« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Vorer-pata-23-12-23.gif
http://www.dailyvorerpata.com/ad/bb.jpg
http://www.dailyvorerpata.com/ad/Screenshot_1.jpg
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]