ড. কাজী এরতেজা হাসান
প্রকাশ: রোববার, ২১ মার্চ, ২০২১, ১২:০০ এএম আপডেট: ২১.০৩.২০২১ ৪:৪৭ এএম | প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে ফের চিন্তিত করে তুলেছে। কিছুদিন করোনা সংক্রমণের হার বেশ নিম্নমুখী হয়ে পড়েছিল। সবাই আশা করেছিল করোনা এবার বিদায় নেবে, শূন্যে নেমে আসবে করোনা সংক্রমণের হার। কিন্তু সবাইকে আতঙ্কে ফেলে দিয়ে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় মানুষের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় সুরক্ষা পেতে একমাত্র স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই মূলমন্ত্র বলে গবেষক-চিকিৎসকরা মনে করেন। গবেষক-চিকিৎসকদের এই পরামর্শ সবাইকে মেনে চলা জরুরি। করোনা সংক্রমণ নিম্নমুখী হয়ে পড়লে অনেকে ফ্রি-স্টাইলে চলাফেরা শুরু করেন।
অনেকে করোনা পূর্ব অবস্থায় চলাচল করতে থাকেন। শপিংমল, বাজারে, গণপরিবহনে মানুষের চলাচলে কেউ স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করছেন না। আরও আশ্চর্য়ের ব্যাপার হলো দেশের পর্যটনকেন্দ্র বিশেষ করে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সপরিবারে ঘুরতে বের হয়েছেন অনেক পরিবার। করোনার মধ্যে তাদের এই আনন্দভ্রমণ কতটা যৌক্তিক, এটা তারা মোটেই ভেবে দেখেননি। এসব কারণে করোনা ফের ঊর্ধ্বমুখী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
করোনার এই ঊর্ধ্বমুখী অবস্থা সরকারকেও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। করোনার নিম্নমুখী অবস্থা দেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে চিন্তায় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জোর আন্দোলন শুরু করে। এতে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত খুলে দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। কিন্তু বর্তমান করোনা সংক্রমণের যে ঊর্ধ্বমুখীতা তাতে বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া নিয়ে সরকারকে নিশ্চয় ভেবে দেখতে হবে।
গতকাল প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘গত চব্বিশ ঘণ্টায় নতুন করে আরও এক হাজার ৮৯৯ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশে মোট করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার ৮৩৮ জনে পৌঁছাল। একই সঙ্গে গত চব্বিশ ঘণ্টায় আরও ১৮ জন করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এ পর্যন্ত মোট আট হাজার ৬৪২ জনের মৃত্যু হলো। এর বিপরীতে গত চব্বিশ ঘণ্টায় আরও এক হাজার ৬১৮ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মোট পাঁচ লাখ ১৯ হাজার ১৪১ জন করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে উঠলেন। করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ একজন মারা যান। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। ওই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এরপর ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। দুই মাস সংক্রমণ নিম্নমুখী থাকার পর নভেম্বরের শুরুর দিকে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। ডিসেম্বর থেকে তা কমতে থাকে। ১৮ জানুয়ারির পর থেকে সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে ছিল।
এরপর শনাক্তের হার প্রতিদিনই ৫ শতাংশের নিচে ছিল। কিন্তু ৯ মার্চ তা বেড়ে ৫ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছায়। ১০ মার্চ শনাক্তের হার আরও বেড়ে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশে দাঁড়ায়। ১১ মার্চ তা কিছুটা কমে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে আসে। ১২ মার্চ তা আবারও বেড়ে ৬ দশমিক ৬২ শতাংশে পৌঁছায়। ১৩ মার্চ শনাক্তের হার কিছুটা কমে ৬ দশমিক ২৬ শতাংশে ছিল। ১৪ মার্চ শনাক্তের হার বেড়ে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছায়। ১৫ মার্চ তা আরও বেড়ে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশে পৌঁছায়। ১৬ মার্চ শনাক্তের হার কিছুটা কমে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে পৌঁছায়। ১৭ মার্চ সংক্রমণ কিছুটা কমে ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশে পৌঁছায়। গত বৃহস্পতিবার শনাক্তের হার ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশে পৌঁছায়। ১০ মার্চ থেকে দৈনিক এক হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার একশ দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুই হাজার ১৮৭ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এর আগে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর দুই হাজার ২০২ জন করোনায় সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়। গত চব্বিশ ঘণ্টায় শনাক্তের হার কিছুটা কমে ১০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশে নেমেছে।’
করোনা সংক্রমণের এই পরিস্থিতি সত্যিই সরকারসহ সবারই উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে। দেশে ইতোমধ্যে বেশ কয়েক লাখ মানুষ করোনাভাইরাস টিকা নিয়েছেন। টিকা কার্যক্রম দেশব্যাপী অব্যাহত রয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার সময়ও আসন্ন। বিশেষজ্ঞরা এ ক্ষেত্রে বলেছেন, করোনা প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার মধ্যবর্তী সময়টা সবারই সাবধান থাকতে হবে। টিকা নিলে মানুষ সর্বোচ্চ সুরক্ষা পাবে বলেও বিশেষজ্ঞদের অভিমত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা টিকাদানের প্রথমেই সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা যাবে না। মাস্ক পরা বন্ধ করা ঠিক হবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই পরামর্শ সবাই মেনে চলছেন বলে আশা করা যায়। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার নড়েচড়ে বসেছে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের লক্ষ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিত হচ্ছে। চট্টগ্রামে ৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। রাজধানী ঢাকাতেও কড়াকড়িভাবে স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পরিশেষে বলা জরুরি, দেশ থেকে করোনা পুরোপুরিভাবে চলে না যাওয়ার আগে প্রত্যেককে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কোনোভাবেই মাস্ক পরা বাদ দেওয়া যাবে না; মাস্ক পরা ব্যক্তি করোনা থেকে বহুলাংশে সুরক্ষা পেয়ে থাকেন।
এজন্য সরকার ঘোষিত ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ আইনটির কড়াকড়ি প্রয়োগ আবশ্যক হয়ে পড়েছে।