প্রকাশ: রোববার, ২১ মার্চ, ২০২১, ১২:০০ এএম | প্রিন্ট সংস্করণ
দেশ ছাড়ার আগে কথার ফুলঝুরি ছড়ালেন বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম তামিম এণ্ড কোং। তারা বললেন, আমরা দেশবাসীকে এবারে একটু ভিন্ন রকম চমক দিতে চাই?নিউজিল্যান্ডে আমাদের সফরকে রাঙাতে নিজেদের প্রস্তুতিতে কোন খাদ রাখিনি। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে নিউজিল্যান্ডে একবার বাঘের গর্জণ তুলতে চাই। আপনারা আমাদের দোয়া করবেন। আমরা এবারে পজিটিভ ক্রিকেট খেলে দেশের জন্য সম্মাণ বয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। এরপর তারা বিমানে চড়ে নিউজিল্যান্ড গেলেন। সেখানে চোদ্দদিনের কোয়ারিন্টাইনে কাটিয়ে নিজেদের ঝালাই করতে অনুশীলনীতে মনযোগ দিলেন।
যুদ্ধে নামার আগে টাইগার কাপ্তান শুনালেন আরও আশার বানী। কিন্তু বাস্তবতা কী বলছে? গতকালের মোকাবিলা থেকে স্পষ্ট হচ্ছে আমরা আবার বিশবছর আগের দলে পরিণত হয়েছি। হতচ্ছিরি ব্যাটিং আর পাড়ার বোলার নিয়ে নিউজিল্যান্ডের মত শক্তিশালী দলের মোকাবিলা করা যে বোকামী সেই বিষয়টি আর একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কিউ বাহিনী।
গতকাল কি অসহায় আত্মসমর্পনই না করলো টিম টাইগার। ডুনেদিনে অনুষ্ঠিত সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচে বাংলাদেশকে ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়েছে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দল। এ জয়ের ফলে সিরিজের ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল কিউইরা। সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৩ মার্চ।ম্যাচের শুরুতে ব্যাট করতে নেমে ট্রেন্ট বোল্ট এবং কাইল জেমিসনদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ৪১.৫ ওভারে সবকটি উইকেট খুইয়ে ১৩১ রানেই দম ফুরিয়ে যায় টাইগারদের। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ২১.২ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় লাথামরা।টস হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে একেবারেই যাচ্ছেতাই ভাবে শুরু করে বাংলাদেশ। প্রথমেই দুই বল ডট দিয়ে তৃতয়ি বলে ছক্কা হাকান টাইগার অধিনায়ক তামিম। এরপরেই আর একটি চার উপহার দিয়ে তিনি শুরুটা ভালোর ইঙ্গিত দেন। এরপর নিজের ১৩ রানের মাথায় দৃষ্টিকটুভাবে নিজের উইকেটটা বিলিয়ে দিয়ে সাজঘরে ফেরেন তিনি। ম্যাচের পঞ্চম ওভারের প্রথম বলে ট্রেন্ট বোল্টের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে সাজঘরে ফেরেন তামিম।তার বিদায়ের রেশ কাটতে না কাটতে ওয়ান ডাউনে নামা সৌম্য সরকার ডেভন কনওয়ের হাতে ক্যাচ দেন। রানের খাতা না খুলেই আউট হয়ে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন সৌম্য। এবারো ঘাতক সেই বোল্ট।এদিকে অভিষেক ম্যাচে ছক্কা মেরে প্রথম আন্তর্জাতিক রান তোলা শেখ মেহেদি হাসান ২০ বল ১৪ রান তুলতে সক্ষম হন। এছাড়া ১০ করেন তাসকিন ইসলাম।নিউজিল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট পেয়েছেন ট্রেন্ট বোল্ট। মাত্র ২৭ রানের খরচায় নিয়েছেন ৪টি উকেট। এছাড়া দুটি করে উইকেট পেয়েছেন জেমি নিশাম ও মিচেল সার্টনার।জবাবে ব্যাট করতে নেমে সহজ পেতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি নিউজিল্যান্ডের। ওপেনিং জুটিতে মার্টিন গাপটিল এবং হ্যানরি নিকোলসের ৫৪ রানের জুটিই জয়ের ভিত গড়ে দেয়। দ্রুত ১৯ বলে ৩৮ রা তুলে টাইগার পেসার তাসকিন আহমেদের বলে আউট হন গাপটিল। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে অভিষিক্ত ডেভন কনওয়েকে নিয়ে ৬৪ রানের জুটি গড়লে জয়ের সুবাস পেতে থাকে স্বাগতিকরা। কিন্তু জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেননি কনওয়ে।৫২ বলে ২৭ রান করে হাসান মাহমুদের বলে আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন তিনি। তৃতীয় উইকেটে উইল ইয়ংকে সঙ্গে নিয়ে শেষ কাজটা করে ফেলেন ওপেনার নিকোলস। ১১ রানে ইয়ং এবং ৪৯ রানে হ্যানরি নিকোলস অপরাজিত থাকেন।
সবই জানত বাংলাদেশ, তবু...ম্যাচের আগেরদিন সংবাদ সম্মেলনে তামিম ইকবাল সাফ বলেছিলেন, এবার অন্তত প্রস্তুতির ঘাটতির কথা বলতে পারবেন না তারা। নিউজিল্যান্ড সফরের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েছে দল, এমনটাই জানিয়েছিলেন ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল। কিন্তু মাঠের খেলায় দেখা গেল এর বিপরীত।ডানেডিন তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের কাছে পাত্তাই পায়নি বাংলাদেশ। টস হেরে ব্যাট করতে নেমে তামিমের দল অলআউট হয়েছে মাত্র ১৩১ রানে। এমন না যে, উইকেট আনপ্লেয়েবল ছিল। এমনটা হলে, এই রান তাড়া করতে নেমে মাত্র ২১.২ ওভারে জিততে পারত না নিউজিল্যান্ড।
ম্যাচ শেষে তামিম অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন নিজেদের ব্যর্থতার কথা। এর পেছনে প্রস্তুতির ঘাটতি কিংবা অন্য কোনো অজুহাতও দেননি তিনি। তামিম সরাসরি বলেছেন, ম্যাচের উইকেট বা কন্ডিশন কেমন থাকবে, তা বাংলাদেশ দলের জন্য নতুন কিছু নয়। বরং নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারায়ই হারতে হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এসে তামিম বলেন, ‘কুইন্সটাউনে আমরা বেশ কিছু দিন কাটিয়েছি। আমাদের প্রস্তুতি ঠিক ছিল। আমি এসব বিষয় নিয়ে কোনো অভিযোগ করতে পারি না। এখানের কন্ডিশন আমাদের জন্য নতুন নয়। আমরা প্রায়ই নিউজিল্যান্ডে আসি। যদিও নিউজিল্যান্ড আমাদের ওখানে যায় না (হাসি)। তো এই কন্ডিশন আমাদের জন্য নতুন না। আমরা জানি, এখানে (কন্ডিশন) কেমন হতে পারে। আমরা আশা করব আগামী ম্যাচে ভাল কিছু করার।’নিশ্চিতভাবেই এমন ম্যাচ হারের মূল দায় ব্যাটসম্যানদের। ব্যাট করতে নেমে ছোট ছোট শুরু পেয়েছিলেন বেশ কয়েকজন ব্যাটসম্যান। কিন্তু কেউই তা কাজে লাগাতে পারেননি। সবাই সাজঘরে ফিরে গেছেন ভালো কিছুর সম্ভাবনা জাগিয়েই। যে কারণে ছয় ব্যাটসম্যান দুই অঙ্কে পৌঁছলেও, ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংসটি মাত্র ২৭ রানের।
ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্সের সমালোচনা করে অধিনায়ক বলেছেন, ‘আলগা শটে অনেক উইকেট হারিয়েছি আমরা। কোনো সন্দেহ নেই যে, তারা দুর্দান্ত বোলিং করেছে। তবু আমার মনে হয়, বেশ কিছু ল্যুজ শট খেলেছি। এর দায় আমাদেরই নিতে হবে। আমরা আমাদের ব্যাটিংয়ের ওপর অনেক গর্ববোধ করি কিন্তু আজ সেটা ক্লিক করেনি। এই উইকেটে ১৩১ রান জেতার মতো ধারেকাছেও ছিল না। আশা করছি আমরা নিজেদের ভুলগুলো বের করতে পারব এবং পরের ম্যাচে আর সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করব না।’
ম্যাচ হারলেও একটা প্রাপ্তির জায়গা হয়তো খুঁজে নিতে পারে বাংলাদেশ দল। মাত্র ৭৮ রানের ৬ উইকেট পড়ার পর ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন অভিষিক্ত শেখ মেহেদি হাসান। মুখোমুখি দ্বিতীয় বলেই উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে কভার দিয়ে হাঁকান ৯৪ মিটার ছক্কা। পরে বোলিংয়ে ৬ ওভারে মাত্র ১৭ রান খরচ করেন তিনি। অভিষেকে নিজের সামর্থ্যের ছাপটা বেশ ভালোভাবেই রাখতে পেরেছেন এ তরুণ।মেহেদির বিষয়ে তামিমের মূল্যায়ন, ‘আমার কাছে প্রথম শটটা অসাধারণ লেগেছে। সে আরও কিছুক্ষণ খেলতে পারলে আমার ভালো লাগত। আমার মতে, সে বোলিংটাও দারুণ করেছে। সবাই জানে, এই কন্ডিশনে স্পিন বোলিং করার খুব একটা সহজ কাজ নয়। তবে আজ মেহেদি নিজের সহজাত সামর্থ্যের ছাপ রেখেছে।’
১৩১ রানে বুক বাংলাদেশ :প্রস্তুতি নিয়ে কোনও ঘাটতি ছিল না। তার পরে ডানেডিনের উইকেটে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। অথচ একই উইকেটে কতটা সহজাত ক্রিকেটই না খেললো নিউজিল্যান্ড।টস হেরে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশ ট্রেন্ট বোল্টের শুরু ও শেষের ধাক্কাতেই এলোমেলো হয়ে যায় ম্যাচে। এই পেসারের সঙ্গে আলো ছড়ান জিমি নিশাম, ম্যাট হেনরি ও কাইল জেমিসনও। পেসারদের পাশাপাশি স্পিনেও সাফল্য পেয়েছেন মিচেল স্যান্টনার। তাদের সম্মিলিত পারফরম্যান্সে ৪১.৫ ওভারে অলআউট হয়েছে তামিম ইকবালের দল। অবশ্য প্রথম ওয়ানডেতে কিউই বোলারদের সাফল্যে সবচেয়ে বেশি অবদান বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদেরই! ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্যই করেছেন তামিম, ‘আমরা ভালো খেলিনি, ভুল শট সিলেকশন ছিল দেখেই ১৩১ রান করেছি। আশা করি সামনের ম্যাচগুলোয় আমরা এমন ভুল আর করবো না। আমাদের অনেক সফট ডিসমিসাল ছিল,এগুলো আর পুনরাবৃত্তি করা যাবে না। পরের ম্যাচে ভালো কিছু করতে হলে কমপক্ষে আমাদের ২৭০-২৮০ রান করতে হবে।’
কিউইদের মাঝে সবচেয়ে সফল বোলার ছিলেন ট্রেন্ট বোল্ট। টপ অর্ডার ও লোয়ার অর্ডার গুঁড়িয়ে দেওয়া বাঁহাতি পেসার ৮.৫ ওভারে ২৭ রান দিয়ে নিয়েছেন ৪ উইকেট। বোল্টের বলে ভুগেছেন তামিম নিজেও। বাংলাদেশ অধিনায়ক জানালেন সকালে ব্যাটিং করাই বেশ কঠিন ছিল, ‘সকালে ব্যাটিং করাটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। সিম হচ্ছিল, সুইং হচ্ছিল। তারপরও আমি মনে করি ভুলটা আমাদেরই। নিজেরা বাজে শট খেলে আউট হয়েছি। যা আমরা আশা করি না। মনে করি ১৩১ রান করার মতো দল আমরা নই, যতই কঠিন পরিস্থিতি থাকুক না কেন।’
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সৌম্য সরকারকে সাত নম্বরে খেলানো হয়েছিল। টিম ম্যানেজমেন্টের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রচুর সমালোচনাও ছিল। শেষ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন নম্বরে ফিরিয়ে আনা হয়েছে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকে। যদিও এখানে টিম কম্বিনেশনের কারণেই আগের অবস্থানে তার সুযোগ মিলেছে। সৌম্যর ব্যাপারে তামিম বলেছেন, ‘সৌম্যকে আমরা সাত নম্বরে দেখেছি। কিন্তু আমরা আজকে যে দল নিয়ে খেলেছি, সেখানে সিক্সথ বোলার কেউ ছিল না। রিয়াদ ভাই তার ব্যাক ইনজুরির কারণে বল করতে পারছেন না। হয়তো এই পুরো সিরিজেও বল করতে পারবেন না। তো ওই কম্বিনেশনে সৌম্যকে দিয়ে বল করানো হয়েছে। এছাড়া তিন নম্বরে ব্যাটিং করার জন্য সৌম্যই সঠিক নির্বাচন ছিল।’