শিল্প, সাহিত্য, ব্যবসা, বাণিজ্য, রাজনীতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্য কালের সাক্ষী। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাঁতসমৃদ্ধ এ জেলা বেশ সুপরিচিত। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর আরও উন্নত হয়ে ওঠে এ শহর। কিন্তু সে তুলনাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লীগুলো। সচেতন মহলের ধারণা পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ না করায় এ শিল্পে যেন ভাটা পড়েছে। ইতোমধ্যে তাঁতশিল্পের অনেক মালিক ফতুর হয়ে পৈতৃক পেশা ছেড়েছেন। একসময় তাঁতসমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জ জেলায় তাঁতীদের দাপট ছিল। যে কারণে এখানকার তৈরি তাঁতবস্ত্রের সুনাম শুধু দেশের মধ্যেই নয় দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।
অথচ দিন যতই যাচ্ছে ততই এ পেশা হুমকির মুখে পড়ছে। নদীভাঙন, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সমস্যা, স্বল্পসুদে ব্যাংক ঋণ না পাওয়া; তাঁত যন্ত্রাংশ, সুতা ও রং-রাসায়নিকের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং সময়মতো ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় দেউলিয়া হওয়াসহ নানাবিধ কারণে তাঁতশিল্প আজ তার সে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। অথচ তাঁতীদের পরিশ্রমের ফল ভোগ করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। সর্বোপরি এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে ঋণ ও দৈন্যদশা নিয়ে হতাশায় রয়েছেন তাঁতীরা।
চলতি মাসের ৮ তারিখ জেলার তামাই গ্রামে গেলে জানা যায় ইতোমধ্যে কয়েক হাজার তাঁতী লোকসানের মুখে তাদের কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতীরা সবাই দেউলিয়া হয়ে পড়বেন। তাঁতপ্রধান এলাকা বেলকুচির চালা অফিসপাড়া মহল্লার ৫৫টি তাঁতের মালিক হাজী তৈয়বার আলীর ছেলে আমিরুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম এবং চালা মধ্যপাড়ার হাজী শফিক জানান, বর্তমানে বিদ্যুৎ, সুতা, রঙ ও যন্ত্রাংশের দাম এবং শ্রমিক মজুরি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় এ পেশা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া একটি ভালো মানের শাড়ি তৈরি করে নামমাত্র লাভে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা বিক্রি করতে হয়। আর দেশের স্বনামধন্য কোম্পানিগুলো ওই শাড়ি কিনে তাদের লেভেল সাঁটিয়ে বাজারে বিক্রি করে দ্বিগুণ লাভে।
একই অবস্থা লুঙ্গিসহ অন্যান্য বস্ত্রের ক্ষেত্রেও। ওই কোম্পানিগুলো অফ সিজনে তাদের দেয়া ডিজাইনে তাঁতীদের কাছ থেকে হাজার হাজার পিস শাড়ি-লুঙ্গি-গামছা কম মূল্যে কিনে মজুদ করে রাখেন। পরে সিজনের সময় নিজেদের লেভেল লাগিয়ে দ্বিগুণ দামে দেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি সৌদি আরব, দুবাই, ভারতসহ বিশ্বের দেশে দেশে রফতানি করে। সিরাজগঞ্জের তৈরি শাড়ি-লুঙ্গি-গামছা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি হচ্ছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে প্রতিনিয়তই রং-সুতাসহ উপকরণের দাম বৃদ্ধি পেলেও খুব একটা বাড়ছে না তৈরি কাপড়ের দাম। তাই লোকসানের শঙ্কায় তাঁতীরা।
সরকার কর্তৃক সম্পাদিত তাঁত শুমারি ২০০৩ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৫ লাখাধিক হস্তচালিত তাঁত রয়েছে তন্মধ্যে সিরাজগঞ্জ জেলাতে রয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজারের অধিক। সিরাজগঞ্জে তাঁতী পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার ৮৭০ এবং তাঁতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৫ হাজারের অধিক। প্রতিবছর এ জেলায় হস্তচালিত তাঁত থেকে প্রায় ২৩ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদিত হয়। এ শিল্প সিরাজগঞ্জের প্রায় ৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান।
সিরাজগঞ্জের তাঁত শ্রমিকরা জানান, আমাদের মজুরি কম, কোন বোনাসও নেই। কাজ করলে মালিকরা টাকা দেয়, না করলে দেয় না। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে আমরা ভালো নেই। বেঁচে আছি এক রকম। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করি। তা ছাড়া সামনে রমজান মাসে খরচ একটু বেশি হবে তাই পরিশ্রম একটু বেশি করছি।
অপরদিকে তাঁত মালিকরা জানান, বাঙালি নারীদের চাহিদা মোতাবেক বিভিন্ন নান্দনিক ডিজাইনের রুচিসম্মত শাড়ি তৈরি হচ্ছে। উৎপাদিত শাড়ি ৩শ থেকে ১০ হাজার টাকায় পাইকারী বিক্রি হলেও রং-সুতার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচের সাথে বিক্রয় মূল্যের সমন্বয় না হওয়ায় আমাদের সাথে শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে তাঁতপ্রধান এলাকা বেলকুচির তামাই গ্রামের ৩৩টি তাঁতের মালিক সাদ্দাম হোসেন, ২৬টি তাঁতের মালিক লিটন ঠাকুর ও ৩২টি তাঁতের মালিক হেলাল মুন্সী জানান, শত শত তাঁতী ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য তাঁত ফ্যাক্টরি বিক্রি করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয় শত শত তাঁতী ঋণ পরিশোধের জন্য ইতিমধ্যে ব্যাংক থেকে নোটিশও পেয়েছেন। সব মিলে এ জেলার তাঁতীদের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছেন।
এ প্রসঙ্গে সিরাজগঞ্জ তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম ও পাওয়ার লুম অনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক হাজি বদি-উজ্জামান জানান, প্রতিনিয়তই রং সুতাসহ তাঁতের উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে তুলনায় কাপড়ের দাম বৃদ্ধি না পাওয়া তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে সময়মত শ্রমিকদের মজুরি ও রং-সুতার দাম, ব্যাংক লোন পরিশোধের জন্য অল্প দামেই তাদের কাপড় বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ অবস্থায় তাঁত শিল্পকে রক্ষা করতে রং-সুতার দাম নির্ধারণসহ স্বল্পসুদে ঋণের জন্য সরকারের নিকট জোড় দাবি জানিয়েছেন তিনি।
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আবু ইউসুফ সূর্য বলেন, সিরাজগঞ্জের অর্থনৈতিক বিষয় তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত। তাই দেশীয় তাঁত শিল্প রক্ষায় সরকারকে তাঁতীদের ঋণসহ রং-সুতায় ভুর্তুকি দিতে হবে। পাশাপাশি অবৈধপথে ভারত থেকে কমদামী শাড়ি আসা বন্ধ করতে হবে। তাহলেই তাঁত শিল্প সমৃদ্ধ হবে।