ড. কাজী এরতেজা হাসান
প্রকাশ: শনিবার, ২০ মার্চ, ২০২১, ১২:০০ এএম আপডেট: ২০.০৩.২০২১ ১২:৫৭ এএম | প্রিন্ট সংস্করণ
সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর আসকারায় উগ্র ধর্মীয় চিন্তা ক্রমান্বয়ে দেশকে পিছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের বিষাক্ত ছোবলে দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি নানা সভায় ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা এমন সব বক্তব্য রাখছেন যা মানুষের শুভবুদ্ধিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি হচ্ছে। উগ্র ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বক্তব্য শুনলে যে কারোর মনে হবে, আমরা কোন সময়ে বসবাস করছি? আমরা কী মধ্যযুগে বসবাস করছি? আমরা কী কোনো অন্ধকার সময়ে বসবাস করছি? এ ব্যাপারে সরকার কতটা ওয়াকিবহাল আমরা জানি না। তবে সরকারের সচেতনতা অনেকটাই জরুরি হয়ে পড়েছে। যেসব উগ্র ধর্মীয় নেতা জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে বিভেদ ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে, তাদের আইনের আওতায় আনাটাও জরুরি হয়ে পড়েছে।
মোদ্দা কথা হলো- এসব ব্যক্তি নিখুঁত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বর্বর পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ধর্মের আড়ালে অপকর্মের পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে যা তাদের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট। এদেরকে সরকার যদি সহনশীলতার দৃষ্টিতে দেখে তাহলে আগামীতে গোটা বাঙালি জাতিকে বড় আকারের মাসুল দিতে হবে। সুতরাং আরও দেরি না করে এদের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এরা বর্বর পাকিস্তানসহ বিভিন্ন অপশক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। এসব অসৎ উদ্দেশ্যে ধর্মীয় সভার নামে দেশের সরল প্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে সচেষ্ট। এসব ধর্মের ছদ্মবেশী নেতাদের যোগাযোগ রয়েছে ’৭১ এর পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ঘাতক জামায়াতের সঙ্গে। এক কথা বলেও বেশি বলা হবে না যে দেশে তথাকথিত ধর্মীয় রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক দলগুলো জামায়াতের এজেন্ডাও বাস্তবায়নে কাজ করছে। ফলে সাবধানতা অবলম্বন ছাড়া কোনো গতি নেই।
গণমাধ্যমগুলো থেকে তার চিত্র ফুটে উঠেছে। উগ্রপন্থি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে, তার নতুন আর একটি নজির হলো হেফাজতে ইসলাম। দলটির নেতা মামুনুল হককে ফেসবুকে কটাক্ষ করার অভিযোগ তুলে তার সমর্থকরা গত বুধবার সুনামগঞ্জের নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুরের পাশাপাশি লুটপাট চালিয়েছে। নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুমন দাস আপন নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে তার ফেসবুক আইডি থেকে মামনুল হককে কটাক্ষ করে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগ তুলে এই হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় সনাতন ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত নোয়াগাঁও ও হবিবপুরের নীরিহ গ্রামবাসীর মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। শুধু তা-ই নয়, ভয়ে গ্রামছাড়া অনেকে এখনো বাড়ি ফেরেননি। পুরুষরা ঘরবাড়ি দেখাশোনার জন্য বাড়ি ফিরলেও নারী ও শিশুদের বাড়ি নিয়ে আসেননি অনেকে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর উস্কানি ও মদদে ‘রামু’তে হামলা-লুটতরাজের মতো ঘটনা ঘটেছিল। রামুবাসীদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়াসহ এলাকাবাসীকে নিগ্রহ করা হয়। রামুর ‘ছক’-এ নোয়াগাঁওয়ে ঘটনা ঘটায় হেফাজতে ইসলামের সমর্থকরা। এ ঘটনার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে সিলেটে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন-সমাবেশ করেছে সামাজিক সংগঠন ‘দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’। গত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকেও ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। প্রতিবাদ থেকে বিতর্কিত হেফাজত নেতা মানুনুল হককে গ্রেফতারের দাবি উঠেছে।
নোয়াগাঁওয়ে যার বিরুদ্ধে কটূক্তির অভিযোগ উঠেছিল, পুলিশ তাকে গত মঙ্গলবার গ্রেফতার করে। তারপরও কেন নোয়াগাঁওয়ে হামলা হলো এ প্রশ্নটি স্বাভাবিক? কেন ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগে একটি সম্প্রদায়ের লোকজন কেন ভয়াবহ হিংস্রতার শিকার হবেন? কেন এবং কোন যুক্তিতে উপাসনালয় ভাঙচুর করা হলো? এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন আগেভাগে সংখ্যালঘু বসতি ও মন্দির এলাকার নিরাপত্তায় জোরালো ব্যবস্থা নেয়নি? যাদের কারণে লুটপাট, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও নিপীড়ন-নির্যাতনের বীভৎস ঘটনা ঘটেছে, এদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নেয় তা দেখার জন্য দেশবাসী অপেক্ষা করছে। অবশ্য আশার কথা, গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সুনামগঞ্জের ঘটনায় তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের আরও জানিয়েছেন, ‘শেখ হাসিনা অপরাধকে অপরাধ হিসেবেই দেখে। অতীতের ধারাবাহিকতায় এ ঘটনায় যুক্তদেরও শাস্তি পেতে হবে। এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি পেতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির ঐক্যবদ্ধতায় শেখ হাসিনার সরকার এ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী বর্ণচোরা অপশক্তিকে কখনো মাথা তুলতে দেবে না।’
পরিশেষে বলতে হচ্ছে যে, দেশের উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলো হলো বর্বর পাকিস্তানের প্রেতাত্মা। সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে এদের দেখা মানেই বাংলাদেশের ধ্বংস ও সর্বনাশ ডেকে আনা। এরা ক্রমশ যেভাবে শক্তি সঞ্চার করে চলছে এবং বাঙালি জাতিসত্তা, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে তা মোটেই দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। এরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুংকার দিয়েছিল। ফলে সরকারকে আমরা একটা কথা জোরালোভাবে বলতে চাই, বিষধর সাপকে বেড়ে উঠতে দেওয়া কখনোই সমীচীন নয়। হেফাজতে ইসলামসহ এ দেশের উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র হায়েনাদের সঙ্গে। এই দলগুলোর বর্তমান নেতাদের বাবা-দাদা-ভাই আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতা করেছে। পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী হিসেবে অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বহু মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। পাক সেনাদের হাতে আমাদের মা-বোনদের তুলেছে ঘাতক জামায়াতসহ বহু ধর্মীয় নেতা। আর দেরি নয়, আর কোনো ভাবনা নয়, বাংলাদেশের বুক থেকে চিরতরে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঝান্ডাকে উৎপাটন করে নিরঙ্কুশভাবে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশের পথ করে দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল কথা এটিই। বলা যেতে পারে ধর্ম যার যার-কিন্তু রাষ্ট্র সবার।