বিশ্ব নারী দিবস ৮ মার্চ। বিশ্ব নারী দিবসটি পালনের পেছনে রয়েছে এক অনন্য ইতিহাস। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে একটি সূচ কারখানার মহিলা শ্রমিকগণ কর্মক্ষেত্রে মানবেতর জীবন ও ১২ ঘন্টা কর্মদিবসের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তাদের উপর নেমে আসে পুলিশি নির্যাতন। ১৯০৮সালে ১৫০০০ নারী কর্ম ঘন্টা, ভাল বেতন ও ভোট দেওয়ার অধিকার দাবি নিয়ে নিউ ইয়র্ক সিটিতে মিছিল করে। তারপর ১৯১০ সালের ৮ মার্চ কোপেনহেগেন শহরে অনুষ্ঠিত এক আর্ন্তজাতিক নারী সম্মেলনে জার্মানির মহিলা নেত্রী কারা জেটকিন ৮ মার্চকে ‘‘আর্ন্তজাতিক নারী দিবস’’ ঘোষণা করেছিলেন। ১৯১১ সালে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ৮ মার্চ ‘‘আর্ন্তজাতিক নারী দিবস’’ পালন করা হয়। ১৯৮৫ সালে ৮ মার্চকে জাতিসংঘ আর্ন্তজাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বিভিন্ন মানবাধিকার ও বিশ্ব সংস্থা গুলো আজ নারী অধিকারের কথা বলছে অথচ প্রায় ১৫শ বৎসর পূর্বেই নারীর সম্মানরক্ষায় ইসলাম সর্বোচ্চ গুরুত্বপ্রদান করেছে। নারীকে মা হিসাবে, কন্যা হিসাবে, বোন হিসাবে এবং স্ত্রী হিসাবে হিসাবে সম্মান প্রদান করেছে এবং নারী ও পুরুষকে একে অন্যের পরিপূরক হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে: “তারা তোমাদের আবরণস্বরূপ আর তোমরা তাদের আবরণ।” [সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৭]।
স্ত্রীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (স.) বলেছেন, উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক। [মুসলিম শরিফ]। তিনি আরও বলেন, তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। [তিরমিজি]। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচরণ করো। [সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৯] কোরআনে আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, নারীদের ওপর যেমন অধিকার রয়েছে পুরুষের, তেমনি রয়েছে পুরুষের ওপর নারীর অধিকার। [সূরা-২ বাকারা, আয়াত ২২৮]
নারীদের তালিম তালবিয়ার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আছে, তোমরা তাদের (নারীদের) সঙ্গে উত্তম আচরণ করো ও উত্তম আচরণ করার শিক্ষা দাও। [সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৯]। মহানবী (স.) ঘোষণা করেন, যার রয়েছে কন্যাসন্তান, সে যদি তাকে (শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে) অবজ্ঞা ও অবহেলা না করে এবং পুত্রসন্তানকে তার ওপর প্রাধান্য না দেয়; আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তিনি আরও বলেন, তোমরা নারীদের উত্তম উপদেশ দাও (উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করো)। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ইলম শিক্ষা করা (জ্ঞানার্জন করা) প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর প্রতি ফরজ (কর্তব্য)। [উম্মুস সহিহাঈন-ইবনে মাজাহ শরিফ]।
তাই হাদিস গ্রন্থসমূহের মধ্যে হজরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২ হাজার ২১০, যা সব সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।মানব সমাজে নারী জন্মের অধিকার প্রতিষ্ঠা, কন্যা সন্তানের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার পর ইসলাম সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষকে সমান ঘোষণা করেছে। জন্মগতভাবে নারী-পুরুষ আল্লাহর কাছে সমান বলে, নারীকে সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে পুরুষের সমকক্ষ ঘোষণা করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ঘোষণা করেছে, হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক উৎস থেকে। আর তা থেকে তোমাদের স্ত্রীদেরকেও সৃষ্টি করেছেন। এরপর তা থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক। [সূরা নিসা, আয়াত ০১]
মহানবী (স.) বলেছেন, মেয়েশিশু বরকত (প্রাচুর্য) ও কল্যাণের প্রতীক। হাদিস শরিফে আরও আছে, যার তিনটি, দুটি বা একটি কন্যাসন্তান থাকবে; আর সে ব্যক্তি যদি তার কন্যাসন্তানকে সুশিক্ষিত ও সুপাত্রস্থ করে, তার জান্নাত নিশ্চিত হয়ে যায়।
মহানবী (স.) বলেছেন, কারও যদি কন্যাসন্তান ও পুত্রসন্তান থাকে আর তিনি যদি সন্তানদের জন্য কোনো কিছু নিয়ে আসেন, তবে প্রথমে তা মেয়ের হাতে দেবেন এবং মেয়ে বেছে নিয়ে তারপর তার ভাইকে দেবে। হাদিস শরিফে আছে, বোনকে সেবাযতœ করলে আল্লাহ প্রাচুর্য দান করেন।
বিধবাদের অধিকার সম্পর্কে মহানবী (স.) বলেছেন, যারা বিধবা নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়, তারা যেন আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং নিরলস নামাজি ও সদা রোজা পালনকারী। [বুখারি ও মুসলিম]
ইসলাম নারীদের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দিয়েছে মা হিসেবে। মহানবী (স.) বলেন, মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার এক লোক মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এর দরবারে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি অধিকারী কে? নবীজি (স.) বললেন, তোমার মা। ওই লোক জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি উত্তর দিলেন তোমার মা। ওই লোক আবারও জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? এবারও তিনি উত্তর দিলেন তোমার মা। [বুখারি]
মহানবী (স.)-এর জামানার বিখ্যাত এক ঘটনার কথা আমরা জানি। মায়ের সেবা করার কারণে হজরত ওয়াইস করনি (রা.) প্রিয় নবীর জামানায় থেকেও সাহাবি হতে পারেননি। একবার ওয়াইস করনি (রা.) নবীজির কাছে খবর পাঠালেন ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনার সঙ্গে আমার দেখা করতে মন চায়; কিন্তু আমার মা অসুস্থ, এখন আমি কী করতে পারি?
নবীজি (স.) উত্তর পাঠালেন, আমার কাছে আসতে হবে না। আমার সঙ্গে সাক্ষাতের চেয়ে তোমার মায়ের খেদমত করা বেশি জরুরি। নবীজি (স.) তাঁর গায়ের একটি মোবারক জুব্বা ওয়াইস করনির জন্য রেখে যান। তিনি বলেন, মায়ের খেদমতের কারণে সে আমার কাছে আসতে পারেনি। আমার ইন্তেকালের পরে তাকে আমার এই জুব্বাটি উপহার দেবে। জুব্বাটি রেখে যান হজরত ওমর (রা.) এর কাছে। এবং প্রিয় নবী (স.) বলেন, হে ওমর! ওয়াইস করনির কাছ থেকে তুমি দোয়া নিয়ো।
আজ পৃথিবীতে অনেকেই নারীদের অনেক অধিকারের কথা বলে, যে যতই অধিকারের কথা বলুক না কেন মূলত ইসলামই দিয়েছে নারীদের পূর্ণ অধিকার ও সম্মান, সুতরাং ইসলামী দিক নির্দেশনা মেনে চলা এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেই আমরা নারীদেরকে পূর্ণ মূল্যায়ন করতে পারব আল্লাহ তাওফীক দান করুন।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।