মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ স্বাধীনতার বিশেষ একটি নিয়ামত তিনি আমাদের দান করেছেন। নয় মাস রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতার বিশেষ নিয়ামত পেয়ে ধন্য হয়েছি আমরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে সুসংহত করা ও সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। ১৯৭১ সালে যারা আমাদের এ অমূল্য স্বাধীনতা অর্জনে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছেন, সেসব শহীদ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। গোটা জাতি তাদের কাছে চিরঋণী। সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে আমাদের সবারই স্বাধীনতা রক্ষা ও ফলপ্রসূ করণে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে।
স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত বিষয়। পৃথিবীতে সীমিত কিছু অধিকার যা অর্জনের জন্য প্রান দেয়াকে মহৎ এবং গর্বের মনে করা হয়,স্বাধীনতা হলো এর মধ্যেথেকে একটি। আল্লাহ প্রতিটি মানুষ কে স্বাধীন করেই সৃষ্টি করেছেন এবং পাশাপাশি বিবেক, বুদ্ধি, হিতাহিত জ্ঞান দিয়েছেন। যে এসব আল্লাহ প্রদত্ত গুন কাজে লাগিয়ে নিজের ও অন্যের স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করবে সে ব্যক্তি, সমাজ এবং আল্লাহ সবার কাছেই সম্মানিত হবে। ইসলাম তার সূচনালগ্নেই স্বাধীনতার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে এর মূলনীতি ঘোষনা করেছে। "প্রতিটি মানুষ জন্ম থেকেই স্বাধীন"
এ বিষয়ে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, পৃথিবীর বুকে তুমিমানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছো, অথচ তার মা তাকে স্বাধীন মানুষ রূপেই জন্ম দিয়েছেন।
আমরা যেন অন্যের স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করি সে বিষয়ে হযরত আলী (রা.) বলেন, সৃষ্টির শুরুথেকে আল্লাহই যখন তোমাকে স্বাধীনমানুষ করে সৃষ্টি করেছেন, তখন কোনো মানুষ কখনো তোমাকে দাস বানাতে পারে না।
ইসলাম মানুষকে বিশ্বাসের, চিন্তার, কথা বলার স্বাধীনতা দিয়েছে আর এগুলোই মানুষের বহুল প্রত্যাশিত।
ধর্মীয় স্বাধীনতা বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা: ইসলামে ধর্মের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি, জবরদস্তির কোন স্থান নেই।মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে সত্য প্রেরণ করেছেন।এখন যার খুশি তা গ্রহন করতে পারে।আল্লাহ জবরদস্তি করতে নিষেধ করেবলেন ‘ধর্মের ক্ষেত্রে জবরদস্তি নেই। মিথ্যা থেকে সত্যকে যথার্থভাবেই পৃথক করে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে।’ [সূরা আল বাকারা: ২৫৬]
এ আয়াতের মাধ্যমে ধর্মের ক্ষেত্রে স্বাধীনতাকে কতটা মর্যাদাদিয়েছে তা স্পষ্ট হয়। ধর্ম গ্রহনে ইসলাম কতটা স্বাধীনতা প্রদান করে তা স্পষ্ট করার জন্য ইসলাম-পূর্ব সময়ের খাজরাজ ও আওস গোত্রের কথা বলা যেতে পারে। সে সময় কোনো মহিলা যদি গর্ভবতী হতে ব্যর্থ হতো, তখন সে ঈশ্বরের নামে মানত করতো যে, ঈশ্বর যদি তাকে একটি বাচ্চা দেন, তাহলে সে তাকে ইহুদি বানাবে। এটা এ কারণে করা হতো যে, আরব উপদ্বীপের এই দুই গোত্রের মধ্যে ইহুদিদের একটাপ্রভাব ছিল। যখন ইসলামের অভ্যুদয় হলো এবং আওস ও খাজরাজ গোত্রের কিছু লোক যখন আল্লাহর প্রতি পরম বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করে ইসলাম গ্রহণ করলো, তখন যেসব বাবা-মা তাদেরমানত পূরণের জন্য নিজেদের সন্তানদের ইহুদী ধর্মের দীক্ষা দিয়েছিল, তারা তখন এই বিরুদ্ধ ধর্ম থেকে সন্তানদের নিষ্কৃতি দিয়ে তাদের নিজ ধর্ম ইসলামে ফিরিয়ে আনতে চাইল।
এ প্রেক্ষাপটে ইসলামের অবস্থা কি ছিল? যদিও ঐ লোকদের ইহুদী সন্তানরা বৈরী পরিবেশের মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করছিল এবং যদিও সে সময় ইসলাম ও ইহুদীদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সংঘাত বিরাজ করছিল, কিন্তুতারপরও ইসলাম কাউকে অন্যের ধর্ম ত্যাগে বাধ্য করানো কিংবা জোর করে ইসলাম গ্রহণ করানো অনুমোদন করেনি। ইসলাম ধর্মের বিষয়ে জবরদস্তি করেনি তবে যদি সচেতন ভাবে যেকোন ধর্মই গ্রহন করে তাকে তা পুরোপুরিভাবে মানতে হবে এবং ঐ ধর্মের বিধান লঙ্গন করলে সে অনুযায়ী শাস্তি পেতেই হবে।
চিন্তার স্বাধীনতা: ইসলাম না জেনে, না বুঝে কোন কিছু তো গ্রহন করতে বলেনি বরং চিন্তা, গবেষনার মাধ্যমে সত্যটা জেনে তারপর সঠিক পথ গ্রহনে উৎসাহিত করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা আসমান জমিনে যা কিছু আছে সব কিছু সম্পর্কে চিন্তা ভাবনার তাগিদ দিয়ে বলে “তাদের বল, জমিন ও আসমানে যা কিছু আছে, তা চোখ মেলে দেখ।’ [ইউনুস : ১০১]”
ইসলামে আন্দাজ, অনুমান, মিথ্যা কল্পনার কোন স্থান নেই। ইসলাম সব বিষয়েই চিন্তা-ভাবনা, গবেষনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। এ বিষয়ে কুরআনে এসেছে, অথচ এ ব্যাপারে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। তারা নিছক আন্দাজ-অনুমানের অনুসরণ করছে মাত্র। আর দৃঢ় প্রত্যয়ের পরিবর্তে আন্দাজ-অনুমান কোনো কাজে আসে না। [আন নাজম : ২৮]
যারা নিজেদের মনগড়া ধারণা কিংবা পূর্ব-পুরুষ ও কর্তাব্যক্তিদের অন্ধ অনুসরণ করে ইসলাম তাদেরকে তিরস্কার করে।
তারা পুনরুত্থান দিবসে আহাজারি করে বলবে: ‘হে আমাদের প্রভু! আমরা আমাদের নেতাদের ও মহান ব্যক্তিদের আনুগত্য করেছি, কিন্তু তারা আমাদের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে বিপথে চালিত করেছে।’ [আল আহযাব : ৬৭]
এদের সম্পর্কে আল কুরআনে আরো বলা হয়েছে: ‘না, বরং এরা বলে, আমরা আমাদের পূর্ব-পুরুষদের একটি পথ ও ধর্মের অনুসারী পেয়েছি আর আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।’ [যুখরুখ : ৬২]
যুক্তি তর্কে উৎসাহীত করে আল্লাহ বলেন” আপনি আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন প্রজ্ঞা ও শোভনীয় উপদেশের মাধ্যমে, এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন উত্তম উপায়ে [ সূরা নাহল,আয়াত ১২৫]”
এ আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় ইসলাম অন্ধো অনুসারনে বিশ্বাসী না।যারা কোন কিছু কেন করি? কেন হয়েছে? এসব না বুঝেই কাজ করে ইসলাম তাদের তিরস্কার করে। ইসলাম বরাবরইযেকোন বিষয়ে মুক্ত চিন্তা,সাক্ষ্য, প্রমান,যুক্তি প্রয়োগের পক্ষে আর কোন ভাবেই গোড়ামি সমর্থন করেনা। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে ইসলাম কতটা স্বাধীন ভাবে চিন্তা ভাবনার প্রতি উৎসাহিত করে।
বাক ও সমালোচনার স্বাধীনতা: ইসলাম মানুষ কে বাক ও যথাযথ সমালোচনার স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলাম অন্যায়, অবিচার, জুলুম এর প্রতি সোচ্চার, এসব বিষয়ে কখনও আপোষ করেনা। এসব বিষয়ের বিরুদ্ধে কথা বলারপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেছে। আর বরাবরের মত সৎ কর্ম সাধনের পাশাপাশি অন্যকেও সৎ কাজে উৎসাহী হওয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। অন্যাকে ভালো কাজের জন্য দাওয়াত দিতে বলাহয়েছে। পবিত্র কুরআনে মানুষদের কল্যাণকর কাজে উৎসাহ এবং মন্দ কাজ প্রতিহত করার আদেশ দিয়ে উল্লেখ রয়েছে ‘সৎ কাজের আদেশ দাও, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখ আর যে বিপদই আসুক নাকেন তার জন্য ধৈর্য ধারণ কর। এসবই আল্লাহ প্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং এ থেকে অব্যাহতি পাওয়া যেতে পারে না।’ [সূরা লোকমান: আয়াত ১৭] ইসলাম মানুষকে বিশ্বাস,কথা,কাজ,চিন্তার স্বাধীনতা প্রদান করেছে ঠিকই তবে যে সব কাজে মানুষের অমঙ্গল নিহিত তা সম্পাদনের বিরুদ্ধ চারণ করে। ইসলাম মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছে এরমানে এই নয় যে নিজে স্বাধীব ভাবে চলতে গিয়ে অন্যের অসুবিধার সৃষ্টি হয়।
আমাদের সকলের নিজের স্বাধীনতার প্রতি সচেতন হওয়ার পাশাপাশি যদি অন্যের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতেপারি, তাদের স্বাধীনতাকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারি তবেই আমার প্রকৃত পক্ষে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াব হব।মানুষ ও আল্লাহর ভালোবাসার পাত্রে পরিনত হব। যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদরা প্রাণ দিয়েছে, সে স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আজ আমাদের ওপর। আজ যদি যোগ্য নাগরিক তৈরি করে এ দেশের সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধি করা নাযায় তা হলে শহীদের সে ত্যাগ বৃথা যাবে। আল্লাহর প্রতি ভয় দেশ প্রেম সততা দিয়ে নিজেকে তৈরি করে বিশ্বের বুকে এ দেশের সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধি করা সম্ভব। শুধু আনুষ্ঠানিকতা, আলোচনা কিংবা শুধু পতাকাউত্তোলন করে শহীদের ঋণ পরিশোধ করা যাবে না বরং এর সঙ্গে সঙ্গে যোগ্য, সৎ ও নিষ্ঠাবান নাগরিক তৈরি করে দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন করে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করা যেতে পারে।
লেখক: খতিব, বাইতুন্নুর জামে মসজিদ।