আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজিজা বা অলৌকিক ঘটনাগুলোর একটি মেরাজ। ২৬ রজব দিবাগত রাতে রাসুল (সা.) আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেন। ঐতিহাসিক সেই সফরকেই মেরাজ বলা হয়।
রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে উম্মে হানির ঘর থেকে জাগ্রত অবস্থায় বোরাকে করে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা, সেখান থেকে প্রথম আকাশ হয়ে সপ্তাকাশ, সেখান থেকে বায়তুল মামুর, সিদরাতুল মুনতাহা, আরশে আজিম পৌঁছে আল্লাহর দিদার লাভ করা-এসবই মেরাজের অন্তর্ভুক্ত। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে আল্লাহ জান্নাত-জাহান্নামের ভবিষ্যৎ চিত্র দেখান। এছাড়াও মহান আল্লাহর অসংখ্য কুদরতের নমুনা নবীজি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন।
আল্লাহর তার প্রিয় হাবিবকে এই উম্মতের জন্য ৫ ওয়াক্ত নামাজ, সুরা তওবার শেষ ২ আয়াত (২৮৫-২৮৬), আর বান্দা তওবা করলে ক্ষমার অঙ্গীকার নিয়ে আসেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, পবিত্র সত্তা তিনি, যিনি বান্দাকে তার নিদর্শনগুলো দেখানোর জন্য রাত্রিকালে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশ পবিত্র, নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সবদ্রষ্টা (বনি ইসরাইল, আয়াত-১)।
মেরাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অন্যান্য নবীর সমস্ত মোজেজা নবী করিম (সা.) এর মধ্যে একত্রিত হয়েছিল। হযরত মুসা (আঃ) তুর পর্বতে খোদার নামে কালাম করেছেন। হযরত ঈসা (আঃ) সশরীরে আকাশে অবস্থান করেছেন এবং হযরত ইদ্রিছ (আঃ) সশরীরে বেহেস্তে অবস্থান করছেন। তাদের চেয়েও উন্নত মকামে বা উচ্চমর্যাদায় আল্লাহ পাক নবী করিম (সা.) কে নিয়ে সবার উপরে তাকে মর্যাদা প্রদান করেছেন। মুসা (আঃ) নিজে গিয়েছিলেন তুর পর্বতে। আর আমাদের প্রিয় নবী করিম (সা.) কে আল্লাহ তাআলা দাওয়াত করে বোরাকে চড়িয়ে ফেরেস্তাদের মিছিল সহকারে বায়তুল মোকাদ্দাছে নিয়েছিলেন। সেখানে সমস্ত নবীগণকে সশরীরে উপস্থিত করে হুজুর করিম (সা.) এর মোক্তাদী বানিয়েছিলেন। সেদিনই নবীগণের ইমাম হতে নবী করিম (সা.) ‘নবীগণেরও নবী’ বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছিলেন।
মুহাদ্দিসীনগণ বলেছেন দুনিয়ার রাজা-বাদশাহদের আগমনে যেমন জনতা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, তার সম্মানে সব যানবাহন, মানুষের কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকে তেমনিভাবে মহানবী (সা.)-এর আগমনে তামাম ব্রহ্মাণ্ডের কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। এখানে স্বাভাবিক প্রশ্ন হতে পারে যে, মেরাজের এমন মর্যাদাপূর্ণ সফরে দুনিয়ার সময়ের গতিকে থামানো হলো কেন? তাফসীরবিদরা এর যৌক্তিক জবাব দিয়েছেন এভাবে যদি দুনিয়ার সময়কে চালু রেখেই আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় হাবিবের ২৭ বছরের মেরাজের সফরের সময় পার করতেন, তাহলে এই সুদীর্ঘ সময়ে জাতি সম্পূর্ণভাবেই খোদাবিমুখ হয়ে যেত এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগেই ফেতনা-ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়তো। কারণ, হযরত মুসা আ. মাত্র ৪০ দিন তুর পর্বতে সাধনা করতে গিয়ে উম্মতের কাছ থেকে দূরে থাকার সময় তার উম্মতেরা বাছুর পূজার ফেতনায় জড়িয়ে ঈমানহারা হয়ে যায়। মহানবী (স)-এর দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে মুশরিকদের পক্ষে ও ইসলামের বিপক্ষে হয়তো এমন জনমত গড়ে উঠতো, যা পরে আর কাটিয়ে ওঠা মুসলমানদের পক্ষে সহজ হতো না। এ ধরনের ঘটনা মহানবীর উম্মতের জীবনে ঘটুক, তা আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেননি বলেই তিনি দুনিয়ার সময়ের গতি বন্ধ করে দিয়েছেন।
পবিত্র মেরাজ রজনীতে মহান আল্লাহ প্রিয় রসুলকে নামাজ উপহার দেন। সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে রয়েছে যে আল্লাহ পাক উম্মতী দের জন্য ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করলেন। ফেরার পথে মুসা (আ.)-এর পরামর্শে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর দরবারে পুনঃপুন গিয়ে শেষাবধি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে আসেন। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করে দেন যে, যে ব্যক্তি গুরুত্বসহকারে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব দান করবেন। ইসলামে নামাযের গুরুত্ব কত সেটা মেরাজের এই সামান্য ঘটনাটাই জানা যথেষ্ঠ। কারণ যত ইবাদাত বন্দেগী মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ফরজ করেছেন তা পৃথিবীতেই করেছেন। কিন্তু নামাজ ফরজ করা হয়েছে স্বয়ং হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে আসমানে ডেকে নিয়ে গিয়ে। ইসলামের প্রত্যেকটি ইবাদতের বিধান আল্লাহতায়ালা হজরত জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর কাছে প্রেরণ করেন। কিন্তু নামাজই একমাত্র ইবাদত যা কোনো মাধ্যম ছাড়া আল্লাহতায়ালা সরাসরি মহানবী (সা.)-এর ওপর ফরজ করেছেন।
নামায এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, তার শর্তাবলী বর্তমান থাকা কালে তা (নাবালক শিশু, পাগল ও ঋতুবর্তী মহিলা ছাড়া) কারো জন্য কোন অবস্থাতেই মাফ নয়। এমন কি যুদ্ধের ময়দানে প্রাণহ্ন্তা রক্ত-পিপাসু শত্রুদলের সামনেও নয়! অসুস্থ অবস্থায় দাঁড়াতে না পারলে বসে, বসে না পারলে কাৎ হয়ে শুয়েও নামায পড়তেই হবে। ইশারা-ইঙ্গিতে রুকু-সিজদা না করতে পারলে মনে মনে নিয়তেও নামায পড়তে হবে। চেষ্টা সত্ত্বেও পবিত্র থাকতে অক্ষম হলেও ঐ অবস্থাতেই নামায ফরয। প্রিয়নবী হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এর অন্তিম অবস্থায় সর্বশেষ ওসিয়ত ছিল আস-সালাত, আস-সালাত। এভাবে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে অনেক কিছু দেখানো হয়, অনেক কিছু জানানো হয়। যত বিষয়ে আমরা না দেখে ঈমান রাখি, সে সব কিছু তাঁকে দেখানো হয়। এটাই মেরাজের শিক্ষা যে, গায়েবের সব বিষয়ে আমাদের বিশ্বাস ও ইয়াকীনকে আরো দৃঢ় করবো এবং মেরাজের রাতে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাযসহ যেসব বিধান আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন সেসব বিধান পালনে পাবন্দ হওয়া।
লেখক: পরিচালক, মুফতী আমীমুল ইহসান একাডেমী।