দেশে করোনা ভাইরাসের প্রভাব বাড়ছে ফের। সেই সঙ্গে জনমনে বাড়ছে আতঙ্ক। গত জানুয়ারি থেকে কোভিড-১৯ এর প্রভাব কমতে শুরু করলেও এ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আবার বাড়তে শুরু করেছে। কোভিড টিকা প্রদান কার্যক্রম চালু থাকলেও ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না এই মহামারিকে। দেশে কোভিড আগমন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিগত বছরের এই সময়ই হানা দিয়েছিল করোনা ভাইরাস। গত বছরের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মহামারি হিসেবে দেখা দিতে থাকে এই ভাইরাস। সে সময় আক্রান্ত হয় ১৭ জন। তারপরই জারি হয় লকডাউন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে গত দুই মাসের মধ্যে গতকালই ছিল সর্বোচ্চ শনাক্ত সংখ্যা। একদিনে শনাক্ত হয়েছে ১০৫১ জন করোনা রোগী। সব মিলিয়ে দেশে মৃতের সংখ্যা সাড়ে ৮ হাজার ছাড়িয়েছে।
দেশে ফের করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিন সতর্কতা নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশবাসীর উদ্দেশে তাঁর দেওয়া তিন নির্দেশনা হলো- এক, টিকা নেওয়ার পাশাপাশি মাস্ক ব্যবহার। দুই, যথাসম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং তিন, জনসমাগম কমিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছিল গ্রীষ্মকালে। তাই এপ্রিল, মে ও জুন মাসের ওপরও দৃষ্টি দিতে বলেছেন তারা। সরকার মহল থেকে বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরও জানিয়েছেন, গত জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে করোনা সংক্রমণ কমিউনিটি পর্যায় থেকে এক ধাপ নেমে ক্লাস্টার (গুচ্ছ) পর্যায়ে। অর্থাৎ ব্যক্তি বা পরিবারের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। ওই সময় সংক্রমণের হার কমে দুই শতাংশে নেমে আসে। তবে গত দুই দিন এ ভাইরাসের সংক্রমণ হার বেড়ে পাঁচ শতাংশের বেশি দাঁড়িয়েছে। তারা বলছেন, পর পর দুই সপ্তাহ করোনা ভাইরাসের এই সংক্রমণ অব্যাহতের হার চলতে থাকলে ফের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হবে।
এদিকে, গত বুধবার পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, করোনার সময়েই সর্বোচ্চ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে দেশে। কোভিড শনাক্ত শুরুর বছরে দেশে বিভিন্নভাবে মারা যাওয়া মোট ৮ লাখ ৫৪ হাজার ২৫৩ জন মানুষের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে সর্বোচ্চ মারা গেছেন ১ লাখ ৮০ হাজার ৪০৮ জন, ডায়াবেটিকে ২৫ হাজার ৬ জন, কিডনির অসুখে ২৮ হাজার ১৭ জন, স্তন ক্যান্সারে ৩ হাজার ১১ জন, ব্রেন স্ট্রোকে মারা গেছেন ৮৫ হাজার ৩৬০ জন আর কোভিডে মারা গেছেন ৮ হাজার ২৪৮ জন। অন্যদিকে, ২০১৯ সালে দেশে বিভিন্নভাবে মারা যায় ৮ লাখ ২২ হাজার ৮৪১ জন মানুষ। অর্থাৎ ২০১৯ এর তুলনায় ২০২০ সালে মৃত্যু বেড়েছে ৩১ হাজার ৪১২ জনের।
রোগতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার সংক্রমণরোধে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি (ঘরের বাইরে বের হলে মুখে মাস্ক পরিধান করা, স্যানিটাইজার ব্যবহার, সাবান অথবা ছাই দিয়ে হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা, জনসমাগমস্থলে না যাওয়া) মেনে চলার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে ব্যাপক উদাসীনতা করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সম্প্রতি করোনার হার কমে যাওয়া ও টিকাদান কার্যক্রম শুরু হওয়ায় মানুষ মনে করছে করোনা চলে গেছে। কিন্তু এটা তাদের ভুল ধারণা। করোনার প্রথম ঢেউ চলাকালীন যেভাবে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ অন্যান্য সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে, আবার সেই সতর্কতা অবলম্বন না করলে সংক্রমণের হার বহুগুণ বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
করোনার এই পরিস্থিতির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও সুবর্ণজয়ন্তীর উপলক্ষ্যে আগামী ২৬ মার্চ ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের চার রাষ্ট্রপ্রধানের আসার কথা থাকলেও তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। তবে, সরকার সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হলে আমন্ত্রিত অতিথিদের অবশ্যই করোনা নেগেটিভ সনদ থাকতে হবে। অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার আগে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই কোভিড টেস্টের রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে। ১০ দিনের ওই প্রোগ্রামে অতিথিরা সশরীরে উপস্থিত থাকবেন চারদিন। বাকি ছয়দিন হবে ভার্চুয়ালি। অনেক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা যুক্ত হবেন ভিডিও বার্তার মাধ্যমে। অনুষ্ঠানের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় বছরব্যাপী যেসব অনুষ্ঠান হবে, সেসব স্থানেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। করোনা সংক্রমণ রোধে সব অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেও অনুরোধ করছেন তিনি।
এদিকে আগামী ৩০ মার্চ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে সংক্রমণের এই হার বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে করোনা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর’র কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি ও বেসরকারি অফিস আদালতে ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ আরও বেশি জোরদার করতে হবে। মাস্ক পরার ব্যাপারে আগে যে কড়াকড়ি ছিল তা আবার শুরু করতে হবে। করোনা ভাইরাসের টিকা দেওয়ার ফলে মৃত্যু সংখ্যা কমে আসবে ঠিকই কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে বৃদ্ধি পাবে সংক্রমণের হার- এমনটাই বলছেন তারা। এরই মধ্যে গত জানুয়ারিতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আগত যুক্তরাজ্যফেরত ছয়জন যাত্রীর মধ্যে পাওয়া যায় করোনার নতুন ধরন। নতুন ধরনের এ ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা সাধারণ করোনার চেয়ে বহুগুণ বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীসহ সারা দেশে ১০ হাজার ২৮৩টি সাধারণ শয্যা ও ৫৬৬টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে।
সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সাধারণ শয্যায় এক হাজার ৬৯৮ জন ও আইসিইউতে ২০৯ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। সাধারণ শয্যা আট হাজার ৫৯৪টি ও আইসিইউ শয্যা ফাঁকা রয়েছে ৩৫৭টি। এছাড়া হাসপাতালগুলোতে ১২ হাজার ৭৭৩টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ৭১৫টি হাই ফ্লো নজেল ক্যানোলা এবং ৬৬০টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর মজুত রয়েছে। দেশে বিগত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। আর প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু হয় এর দশদিন পর, ১৮ মার্চ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত একদিনে দেশে ১১৮টি আরটি-পিসিআর ল্যাব, ২৯টি জিন-এক্সপার্ট ল্যাব ও ৭২টি র্যাপিড অ্যান্টিজেন ল্যাবে অর্থাৎ সর্বমোট ২১৯টি ল্যাবে ১৮ হাজার ৫৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৪২ লাখ ১৬ হাজার ২৮টি নমুনা। গত একদিনে পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
বিশ্বে করোনা রিপোর্ট প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠান জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য মতে, বিশ্বে শনাক্ত করোনায় রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে ১১ কোটি ৮০ লাখ পেরিয়েছে, মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৬ লাখ ১৯ হাজার। সারাবিশ্বে শনাক্তের দিক থেকে ৩৩তম এবং মৃতের সংখ্যার দিক থেকে ৩৯তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।