দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ গত জানুয়ারি থেকে কমতে শুরু করলেও মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে ফের বাড়তে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) একদিনে ১০৫১ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত দুই মাসের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ শনাক্ত সংখ্যা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ফের কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। গত জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে করোনা সংক্রমণ কমিউনিটি পর্যায় থেকে এক ধাপ নেমে ক্লাস্টার (গুচ্ছ) পর্যায়ে, অর্থাৎ ব্যক্তি বা পরিবারের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। ওই সময় সংক্রমণের হার কমে দুই শতাংশে নেমে আসে। তবে গত দুই দিন এ ভাইরাসের সংক্রমণ হার বেড়ে পাঁচ শতাংশের বেশি দাঁড়িয়েছে।
তারা বলছেন, পর পর দুই সপ্তাহ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হার পাঁচ শতাংশ কিংবা তার চেয়ে বেশি অব্যাহত থাকলে ফের কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা যাবে।
এদিকে আগামী ৩০ মার্চ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার কথা রয়েছে। বর্তমানে সংক্রমণের হার বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকর উদ্বিগ্ন।
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্যরা নতুন করে উদ্বিগ্ন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে মঙ্গলবার (৯ মার্চ) কমিটির সদস্যরা অনলাইনে জুম মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। আলোচনাক্রমে তারা সরকারকে খুব শিগগিরই কিছু পরামর্শ দেবেন বলে জানা গেছে।
রোগতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার সংক্রমণরোধে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি (ঘরের বাইরে বের হলে মুখে মাস্ক পরিধান করা, স্যানিটাইজার ব্যবহার, সাবান অথবা ছাই দিয়ে হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা, জনসমাগমস্থলে না যাওয়া) মেনে চলার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে ব্যাপক উদাসীনতা করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সম্প্রতি করোনার হার কমে যাওয়া ও টিকাদান কার্যক্রম শুরু হওয়ায় মানুষ মনে করছে করোনা চলে গেছে। কিন্তু এটা তাদের ভুল ধারণা। করোনার প্রথম ঢেউ চলাকালীন যেভাবে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ অন্যান্য সতকর্তা অবলম্বন করা হয়েছে, আবার সেই সতকর্তা অবলম্বন না করলে সংক্রমণের হার বহুগুণ বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলমগীর হোসেন বলেন, নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যেন না বাড়ে সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার ওপর আরও বেশি গুরত্বারোপ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি অফিস আদালতে ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ আরও বেশি জোরদার করতে হবে। মাস্ক পরার ব্যাপারে আগে যে কড়াকড়ি ছিল তা আবার শুরু করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা ভ্যাকসিন দিচ্ছি, সংক্রমণ একটু কমেছে বলে সবাই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছি, যা মোটেই কাম্য নয়। বিশেষ করে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ব্যাপক জনসমাগমে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলায় চরম ঝুঁকি তৈরি করছে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সচেতনতা জরুরি। পাশাপাশি এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে গণমাধ্যম গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
দেশে গত জানুয়ারিতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আগত যুক্তরাজ্যফেরত ছয়জন যাত্রীর মধ্যে করোনার নতুন ধরন পাওয়া যায়। নতুন ধরনের এ ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা সাধারণ করোনার চেয়ে বহু গুণ বেশি।
করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোশতাক হোসেন বলেন, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়েও ক্লাস্টার পর্যায়ে করোনার সংক্রমণ ছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণের হার বাড়ছে এবং এ হার দুই সপ্তাহ অব্যাহত থাকলে তা ফের কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করতে হবে।
তিনি বলেন, ক্লাস্টার পর্যায়ে সংক্রমণ ঘটলে রোগীকে দ্রুত চিহ্নিত, তার সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন করা সহজ হয়। কিন্তু কমিউনিতে ছড়িয়ে পড়লে এ কাজগুলো করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত কি না জানতে চাইলে ড. মোশতাক বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত ঠিকই আছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা পরোক্ষভাবে জনস্বাস্থের জন্য ক্ষতি।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, দরিদ্র শিক্ষার্থীরা কায়িক পরিশ্রমের কাজে যুক্ত হচ্ছে। মেয়েদের বাল্যবিবাহ হচ্ছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অন্য ঝুকিপূর্ণ পেশায় চলে যাচ্ছে। তবে খোলার আগে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। ইতোমধ্যে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের টিকা দেয়া হচ্ছে।
ড. মোশতাক হোসেন বলেন, করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার ফলে মৃত্যু সংখ্যা কমে আসবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীসহ সারাদেশে ১০ হাজার ২৮৩টি সাধারণ শয্যা ও ৫৬৬টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সাধারণ শয্যায় এক হাজার ৬৯৮ জন ও আইসিইউতে ২০৯ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। সাধারণ শয্যা আট হাজার ৫৯৪টি ও আইসিইউ শয্যা ফাঁকা রয়েছে ৩৫৭টি। এছাড়া হাসপাতালগুলোতে ১২ হাজার ৭৭৩টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ৭১৫টি হাই ফ্লো নজেল ক্যানোলা এবং ৬৬০টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর মজুত রয়েছে।
দেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। আর প্রথম করোনা রোগী মৃত্যু হয় এর দশ দিন পর, ১৮ মার্চ। বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫০২ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা এই সময়ে করোনা শনাক্ত হয়েছে এক হাজার ৫১ জনের। মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫৪ হাজার ১৫৬ জন।
ভোরের পাতা এনই