করোনা মহামারি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে দেশের নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রায়। মজুরির বিনিময়ে কাজ করা ৬২ শতাংশ কর্মীর বেতন কমেছে। কাজ হারিয়েছেন প্রায় ৮ শতাংশ কর্মী, পেশা পরিবর্তন করেছেন প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ কর্মী। গতকাল বুধবার সানেমের আয়োজনে ‘কর্মসংস্থান ও অভিবাসনের ওপর মহামারির প্রভাবঃ সানেমের জরিপের ফলাফল’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে এ তথ্য দেওয়া হয়। ২০২১ সালের জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাসে জরিপটি চালানো হয়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে অনেক কর্মজীবীর আয় কমে গেছে, ব্যবসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ হারানোর ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। কৃষিখাতে বেতন বা মজুরিতে কাজ করেন, এমন শ্রমজীবীরা জানান, তাদের আয় কমেছে। একই অবস্থা তৈরি পোশাক খাত, অবকাঠামো খাত, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় কাজ করা কর্মীদের। অনেক কমে গেছে তাদের আয়।
২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মজীবী মানুষের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। তবে শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে চাকরি হারানো বা মজুরি কমার হার কম। তবে গেল বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বরে ৪৯ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, বেতন পাননি, কম বেতন পেয়েছেন কিংবা বেতন পরিশোধ করতে না পেরে শহর ছেড়ে চলে গেছেন। তারা আবার শহরে এসেছেন কাজ খুঁজতে। তবে জরিপে দেখা গেছে, ২০ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক মার্চ থেকে ডিসেম্বরে কাজ হারিয়েছেন। বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে ৫ শতাংশ দেশে ফিরে এসেছেন। পুরো ওয়েবিনারে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা। তিনি বলেন, যেসব খাতের কর্মজীবীরা এখনো
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ধারায় পিছিয়ে আছে, তাদের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। এসব খাতের মধ্যে আছে পরিবহন, নির্মাণ এবং হোটেল ও রেস্টুরেন্ট। এসব খাতের জন্য ন্যূনতম শর্তে বিশেষায়িত প্রণোদনা দেওয়ার প্রয়োজন। একইসঙ্গে আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিতরা তুলনামূলকভাবে পুনরুদ্ধারে পিছিয়ে আছেন, তাদেরও নীতি সহায়তার প্রয়োজন আছে।
কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ফিরে আসা প্রবাসীদের আবার কাজে পাঠানোর বিষয়ে সচেষ্ট থাকার পাশাপাশি বাইরে কাজ করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে খরচ, তা কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ফিরে আসা শ্রমিকদের দেশের শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াসও পাশাপাশি চালাতে হবে।
ওয়েবিনারটি পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, শুধু অর্থনীতিই নয়, দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং কর্মসংস্থানের জন্যও কোভিড-১৯ একটি সংকট। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে এই বিষয়গুলোকে বিবেচনা করতে হবে। বালাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হলেও, আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, মহামারির আগে থেকেই বেসরকারি বিনিয়োগ, বিদেশি বিনিয়োগ আর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ধীরগতি ছিল। কোভিড-১৯ এই সমস্যাগুলো আরও জটিল করেছে। তাই অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া নির্ভর করছে কত দ্রুত এই বাজারগুলোর পুনরুদ্ধার করা যায়। যেসব অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো শুধু পণ্য ও সেবা বাজার কেন্দ্রিক। পুঁজি বাজার বা শ্রমবাজার পুনরুদ্ধারের জন্য নীতি নেই বললেই চলে, বা থাকলেও তেমন প্রভাবশালী না। তাই সার্বিক পুনরুদ্ধার তেমন শক্তিশালী নাও হতে পারে। অর্থনৈতিক নীতি গঠনের ক্ষেত্রে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সুবিশাল শ্রম বাজারকেও বিবেচনায় নিতে হবে।
ওয়েবিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’র (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পওতিয়ানেন। ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার ড. তাসনিম সিদ্দিকী এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। ওয়েবিনারে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৭০ জন ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন।