অবশেষে মহামারি করোনা ভাইরাসের টিকা পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। আজ থেকে করোনার টিকা দেওয়া শুরু করছে সরকার। প্রথম পর্যায়ে ২৫ জনকে এই টিকা দেওয়া হবে। যার ভেতরে প্রথম ভাগ্যবান একজন নার্স। রুনু নামের এই নার্স কাজ করেন দেশের কুর্মিটোলা হাসপাতালে। যে হাসপাতালটি করোনাকালীন সময়ে সারা দেশের বেশিরভাগ মানুষের আশ্রয়ে পরিণত হয়। সীমিত সামর্থ আর প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকার পরেও এই হাসপাতালটি করোনা আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত থেকেছে। সেই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র নার্স রুনু বেরুনিকা কস্তাকে দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু হবে। রুনুর পর আরও দুই নার্সকে টিকা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে এদিন টিকা নেবেন তিন চিকিৎসক। টিকাদানের সব প্রস্তুতি এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ভার্চুয়াল মাধ্যমে আজ বিকেলে টিকা কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরপরই কোভিড-১৯ এর টিকা পাবেন রুনু। আর সারা দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে ৭ ফেব্রুয়ারি।
কুর্মিটোলা হাসপাতালের একজন নার্স জানান, রুনুসহ হাসপাতালটির তিনজন নার্স এবং তিনজন চিকিৎসক আজ বুধবার এই টিকা পাচ্ছেন। টিকা প্রদানের জন্য যে তালিকা করা হয়েছে, সে অনুযায়ী প্রথমে টিকা নেবেন ডায়ালাইসিস ইউনিটের ইনচার্জ ও সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু বেরুনিকা কস্তা। এরপর ফিমেল মেডিসিন ইউনিটের ইনচার্জ ও সিনিয়র স্টাফ নার্স মুন্নি খাতুন এবং একই ইউনিটের নার্স রিনা সরকার। হাসপাতালটির চিকিৎসকদের মধ্যে টিকা নেওয়ার তালিকায় প্রথমে রয়েছেন কনসালট্যান্ট লুৎফর কবির মবিন ও শাহরিয়ার আলম। তবে আরেক চিকিৎসকের নাম এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। জানা গেছে, টিকা পাবেন এমন তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের শেষ মুহূর্তের শারীরিক অবস্থা দেখেই তাদেরকে টিকা দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কারো শারীরিক সমস্যা থাকলে তালিকায় রদবদলও আসতে পারে।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জামিল আহমেদ জানান, আগামী কাল (আজ) টিকা প্রয়োগের সব প্রস্তুতি শেষ করা হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ভাইরাসের প্রথম টিকা নিচ্ছেন ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাসান চৌধুরী। তিনি টিকা পাচ্ছেন আগামীকাল বৃহস্পতিবার। ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন অ্যান্ড ইনফেকশন বিশেষজ্ঞ ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাসান চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ডা. ফরহাদ বলেন, ‘আগামীকাল (আজ) টিকা কার্যক্রমের উদ্বোধন হবে বলে নিশ্চিত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এখন পর্যন্ত টিকা নেয়ার তালিকায় আমিই প্রথমে আছি। সবকিছু ঠিক থাকলে আমিই ঢামেকে সবার আগে টিকা নিচ্ছি।’
এ চিকিৎসক বলেন, ‘টিকা গ্রহণ নিয়ে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। মূলত এটা দূর করার জন্য চিকিৎসক-নার্সসহ যারা ফ্রন্টলাইনার রয়েছেন, তারা প্রথম টিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের এই উদ্যোগটা মূলত সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্যই। এটা সাকসেসফুল হলে আশা করি সারা দেশের মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে এই টিকা গ্রহণ করবে।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক জানান, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী উৎসবমুখর পরিবেশে টিকা দেওয়া শুরু হবে। প্রথমে চিকিংসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকা পাবেন। হাসপাতালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের ধারাবাহিকভাবে টিকা দেওয়া হবে। টিকা দেওয়ার পরে ওই ব্যক্তিকে ৩০ মিনিট পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আন্ডারগ্রাউন্ডে টিকা দেওয়ার স্থান নির্ধারণ করেছে কর্তৃপক্ষ। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা ভাইরাসের টিকা বাংলাদেশে দেওয়া হবে।
সরকার সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে যে তিন কোটি ডোজ টিকা কিনছে, তার প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ গত সোমবার দেশে পৌঁছেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর প্রথম চালানের টিকা মানবদেহে প্রয়োগের অনুমতিও দিয়েছে। এছাড়া সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত আরও ২০ লাখ ডোজ টিকা ভারত সরকারের উপহার হিসেবে পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে যেহেতু এ টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়নি, তাই প্রথম দফায় ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর প্রয়োগ করে দেখা হবে। সব ঠিক থাকলে ৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে সারা দেশে টিকাদান।
উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী :কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন নার্সসহ ২৫ জনকে টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে সারা দেশে করোনা ভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম শুরু হচ্ছে আজ বুধবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিকেলে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন। তিনি ভিডিও কনফারেন্সেই প্রথম ৫ জনের ওপর টিকার প্রয়োগ সরাসরি প্রত্যক্ষ করবেন। গতকাল মঙ্গলবার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে টিকাদান কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি দেখতে এসে সাংবাদিকদের এসব জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা ভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন। এর মাধ্যমেই দেশে টিকা দেওয়া শুরু হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী যুক্ত হয়ে প্রথম পাঁচজনকে টিকা দেওয়া দেখবেন।’ মন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের টিকার জন্য নিবন্ধন কার্যক্রমও চালু হয়ে যাবে। আগামী কাল (বৃহস্পতিবার) ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালের ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। সারা দেশে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি। প্রথম যারা টিকা পাবেন, তাদের মধ্যে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াও পুলিশ, সেনাবাহিনী, গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ থাকবে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
ভ্যাকসিন নিয়ে অপপ্রচার :ভ্যাকসিন আসার পর থেকে নানা ধরনের অপপ্রচার করা হয়েছে। এই ভ্যাকসিন নিলে অনেক মারাত্মক পাশর্^প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে, ভ্যাকসিন কোনভাবেই এই রোগ প্রতিরোধে কাজ করবে না এমনি ধরনের মনগড়া মন্তব্য করে সাধারণ মানুষের মনে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত লক্ষ্য ছিল ভ্যাকসিন প্রয়োগে সরকারি পদক্ষেপকে বানচাল করা। ভ্যাকসিন নিয়ে এই ধরনের নেতিবাচক প্রচারের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের একটি বড় অংশ অবস্থান নেন। তারা ভ্যাকসিনের স্বপক্ষে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। ভোরের পাতার সঙ্গে কথা হয় দেশের বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি ভ্যাকসিন বিষয়ে জনগণের ভ্রান্ত ধারণা এবং অপপ্রচারের কথা তুলে ধরে বলেন, বিশে^র উন্নত দেশগুলো করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য ভ্যাকসিনের উপর আস্থা রেখেছে। এরই মধ্যে তারা নিজেদের দেশের নাগরিকদের উপর তা প্রয়োগ করেছেন। সুফলও পেয়েছেন। বিশে^ সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত দেশ সমূহে এরই মধ্যে তাদের পঞ্চাশ শতাংশ লোকের উপর তা প্রয়োগ করেছে। ভ্যাকসিন বা টিকা সাধারণত দুটি ডোজে ব্যবহারকারীদের জন্য প্রয়োগ করার বিধান। তার প্রথম ডোজের প্রয়োগ তারা স্বার্থকভাবে শেষ করেছে। কই তারা তো কোন অসুবিধায় পড়েনি? যদিও লাখে এক দু’জন পাশর্^প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন যা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে যারা আগের থেকে কোন জটিল রোগে ভুগছেন তাদের জন্য একধরনের পাশর্^ প্রতিক্রিয়া দেখা যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে সার্বিকভাবে আমি মনে করি এই মানবিক বির্পযয়কালীন সময়ে করোনা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের অবশ্যই টিকা নিতে হবে। এ নিয়ে কোন সমালোচনার সুযোগ নেই।
কথা হয় মোহাম্মদপুরের চাকরিজীবী সৈমিত্র হাসানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি কবে আমি টিকা নিতে পারব? তাকে প্রশ্ন করা হয় টিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের ভেতরে নেতিবাচক মনোভাব আর অপপ্রচার রয়েছে এরপরেও আপনি টিকা নেবেন? হাসান জানালেন, দেখুন, আমাদের দেশে ভালো কাজের সমালোচনা করে এক শ্রেণির মানুষ তৃপ্তি পায়। তাদের কাজই হচ্ছে সব কিছু প- করা। কই, যখন আমার পরিবার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলো মানে পরীক্ষায় পজিটিভ এলো তখন তো কেউ আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। বরং যে বাসায় আমি দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছি সেই বাসা ছেড়ে দেওয়ার জন্য বাড়িওয়ালার উপর চাপ সৃষ্টি করা হলো। আমার স্ত্রী তখন বড় অসহায় হয়ে তাদের কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করেছে। কই তাদেরতো মন গলেনি? পরে ৩৩৩ এ ফোন দিয়ে যখন বিষয়টি জানানো হলো তখন সেই সংস্থার লোক এসে আমার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। হাসপাতালে দ্বিতীয় পরীক্ষায় আমার করোনা নেগেটিভ হলেও আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। আমার রিপোর্ট ভুয়া দাবি করে আমি যাতে বাসায় বা মহল্লায় আসতে না পারি তার জন্য কম চেষ্টা করা হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের কারণেই আমি আবার আমার সংসার ফিরে পেয়েছি। তবে এখনও আতঙ্কে থাকি। আমার সন্তান এবং স্ত্রী যেন করোনায় আক্রান্ত না হন। তবে ভরসার কথা সরকার করোনার টিকা আমদানি করেছেন। এবং কাল (আজ) থেকে তার প্রয়োগ শুরু হচ্ছে।
কথা হয় ঢাকা মীরপুরের বাসিন্দা সাইফুল সরোয়ার ববির সঙ্গে। যিনি একটি এনজিওতে চাকরি করেন। তার অফিস মোহাম্মদপুরে। প্রতিদিন তাগে গণপরিবহনে করে অফিসে আসতে হয়। করোনা ভীতি কাটাতে তিনি মাস্কসহ পিপিই ব্যবহার করেন। সেই তিনি যেমনটি বললেনÑ টিকা দেশে এসেছে এখবর শুনে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে একটি বড় বোঝা নেমে গেল। এতদিন আমরা টিকার অপেক্ষায় ছিলাম। উন্নত বিশ^ বেশ আগেই টিকা পেয়েছে এবং তারা তা ব্যবহারও করছে। কিন্তু আমদের দেশে সেটি একটু দেরীতেই এসেছে। তারপরেও আমাদের স্বস্তি সরকার বেশ দ্রুততার সঙ্গেই এই টিকা দেশে আনতে সক্ষম হয়েছে। উপহার আর কেনা টিকা মিলিয়ে আমরা বেশ বড় একটা লট পেয়েছি। আরও টিকা দ্রুততম সময়ে আসবে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে। আমি এই টিকা আসায় ভীষণ খুশি। টিকার বিষয়ে অপব্যাখ্যা এবং প্রপোগান্ডার বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুল সরোয়ার ববি বলেন, এই সব মিথ্যাচার এবং অপপ্রচারের কোন ভিত্তি নেই। এরা ভালোকাজকে প- করতে জানে। এদের অপপ্রচারের পিছনে বৈজ্ঞানিক কোন যুক্তি নেই। বরং বলা যেতে পারে ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।’ দেশের বৃহত্তর অংশ এসব কানে তুলে না। বরং সরকারের এই মহতী উদ্যোগকে সমর্থন করে। আমি নিজে আশাবাদী দেশের সব বয়সের এবং সব ধরনের মানুষ পর্যায়ক্রমে টিকা পাবে। এই বিশ^াস আমার এজন্য যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তাই করেন। যেহেতু তিনি বলেছেন পর্যায়ক্রমে দেশের সব মানুষ টিকা পাবে সেই কথার উপর আমার আস্থা শতভাগ।