কৃষক আন্দোলনের চাপে ভারতের রাজধানী দিল্লি অনেকটাই বেসামাল। রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে দিল্লি। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে এই বিদ্রোহে বড় ধরনের চাপে ফেলেছে বিজেপিকে। মোদির কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। হাজারো কৃষক এখন দিল্লির লালকেল্লার নিয়ন্ত্রণ বুঝে নিয়ে তাদের ঝাণ্ডা উড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় বাংলা গণমাধ্যম আনন্দবাজার জানিয়েছে, পুরো দিল্লি এখন কৃষক আন্দোলনে প্রকম্পিত। নয়া কৃষি আইন বাতিলের শ্লোগানে এখন রাজধানী দিল্লি মুখরিত। এতদিন যারা প্রবেশ পথে আটকে ছিলেন তারা এখন বাঁধ ভেঙে দিল্লির লাল কেল্লায় উপস্থিত হয়েছেন। তবে তাদের এই যাত্রাকে আটকে দিতে মোদির পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, জল কামান থেকে রাইফেলের গুলি ব্যবহার করেছে। এরই মধ্যে একজন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ বলছে তিনি ট্রাক্টর উল্টে মারা গেছেন। কিন্তু বিদ্রোহীদের ভিন্ন সুর, পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হয়েছেন। যদিও এবিষয়ে এই পর্যন্ত সঠিক তথ্য কোন গণমাধ্যম দিতে পারেনি।
কৃষক আন্দোলনের নতুন মাত্রা :ভারতে নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত হাজার হাজার কৃষক হেঁটে ও ট্রাক্টর নিয়ে রাজধানী দিল্লির কেন্দ্রস্থলে ঢুকে পড়েছেন, নগরীর কেন্দ্রস্থলে তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে। স্থানীয় সময় দুপুরের পর দিল্লির লাল কেল্লায় ২০টিরও বেশি ট্রাক্টর প্রবেশ করেছে বলে এনডিটিভি জানিয়েছে। জাতীয় পতাকা নিয়ে ট্রাক্টর চালিয়ে লাল কেল্লায় প্রবেশের পর প্রতিবাদকারীদের সেøাগান দিতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে তারা। এর আগে সকালে নগরীর কয়েকটি প্রবেশপথে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে হাজার হাজার আন্দোলনকারী কৃষক রাজধানীতে প্রবেশ করে। নির্ধারিত যে পথ ধরে কৃষকদের মিছিল করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সেগুলো থেকেও সরে যান তারা। গতকাল দিল্লির স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ‘কৃষাণ প্যারেড’ এর অনুমতি দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তার অনেক আগেই রাজধানীতে মিছিল শুরু করে দেন কৃষকরা। পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে ও লাঠি পেটা করেও তাদের আটকাতে পারেনি।
সংঘর্ষে কিছু পুলিশও আহত হয়েছেন। ভারতের ৭২তম প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির কেন্দ্রস্থলে ‘রাজপথে’ বার্ষিক প্যারেড শেষ হওয়ার পর ট্রাক্টর মিছিল করবে, এই শর্তে কৃষকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্যারেড শুরু হওয়ার আগেই সকাল ৮টার মধ্যে হাজার হাজার আন্দোলনকারীরা দিল্লির সীমান্তে জড়ো হয়। এরমধ্যে কয়েক হাজার পুলিশের বাধা তুচ্ছ করে হেঁটে রাজধানীতে ঢুকে পড়ে।
পূর্ব নির্দিষ্ট সড়ক ধরে না গিয়ে বিভিন্ন রাস্তা ধরে মিছিল করে নগরীর কেন্দ্রস্থলের দিকে রওনা হয় তারা। এই নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয় বলে জানিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা। দিল্লির নয়ডা মোড়, আইটিও মোড় ও এসবিটি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। আইটিও মোড়ে কৃষকরা পুলিশের একটি বাস দখল করে নিয়েছে বলে জানা গেছে। কৃষকদের মিছিল লাল কেল্লায় পৌঁছে যাওয়ার পর তারা সেখানে আন্দোলনের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছেন। এখানে আন্দোলনকারী কৃষকরা ‘অকুপাই দিল্লি’ বলে সেøাগান দিচ্ছে, জানিয়েছে আনন্দবাজার। আন্দোলনকারী কৃষকদের ব্যাপক উপস্থিতিতে পুলিশ অসহায় হয়ে পড়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দিল্লির মেট্রো পরিষেবা আংশিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
মৃত্যু নিয়ে কী বলছে পুলিশ: পুলিশের সঙ্গে খণ্ড যুদ্ধে এক কৃষকের মৃত্যু ঘটেছে। তবে পুলিশ এবিষয়ে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলছে, নিহত কৃষক ট্রাক্টর উল্টে মারা গেছেন। যদিও আন্দোলনরত কৃষকরা পুলিশের এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে নারাজ। বিক্ষুব্ধ কৃষক হরজিৎ সিংহ জানান, আমাদের সহকর্মীকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গে ঢোকার মুখে আমাদের পথ আটকায় পুলিশ। এমনকি গুলিও চালায়। পুলিশের সেই গুলি ট্রাক্টরটিতে এসে লাগে। তাতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায় ট্র্যাক্টরটি। তার নীচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় ওই কৃষকের। যদিও কোন পক্ষই নিহতের পরিচয় জানাতে পারেনি। তবে এই ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে আন্দোলনকারীদের মধ্যে। ব্যারিকেড ভেঙে লালকেল্লায় ঢুকে পড়েন তারা। সেখানে একাধিক স্তম্ভের মাথায় কৃষক সংগঠনের পতাকা ঝুলিয়ে দেন। কেল্লার সামনের খুঁটি বেয়ে উঠে পতাকা টাঙিয়ে দিতে দেখা যায় এক আন্দোলনকারীকে। সেই নিয়ে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি চরমে ওঠে। কৃষকদের শান্তিপূর্ণ মিছিল এ ভাবে হিংসাত্মক হয়ে ওঠায় অশান্ত হয়ে উঠেছে রাজধানী দিল্লি। বিষয়টি এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। যে কোন সময়ে আরও ব্যাপক ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এদিকে সব ধরনের হিংসা এড়াতে কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কংগ্রেস। কৃষকদের শান্তি বজায় রাখার আর্জি জানিয়ে কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী টুইট করেছেন। টুইটারে তিনি লেখেন, ‘হিংসা কখনও সমস্যার সমাধান করতে পারে না, চোট যেই পান, ক্ষতি গোটা দেশের’। টুইটে তিনি দেশের মঙ্গলের কথা ভেবে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে কেন্দ্রকেও আর্জি জানান।
কী বলছে দিল্লি পুলিশ :আন্দোলকারীদের শান্তি বজায় রাখার বার্তা দেওয়া হয়েছে দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে। পুলিশের অতিরিক্ত জন সংযোগ কর্মকর্তা অনিল মিত্তল বলেন, ‘আন্দোলনকারী কৃষকদের অনুরোধ করব, দয়া করে আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। শান্তি বজায় রাখুন।’ এদিকে পুলিশের মার, লাঠি চার্জ, কাদুনে গ্যাস ব্যবহার, ট্রাক্টর চাপা দিয়ে মারার চেষ্টায় এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কৃষক বিক্ষোভে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে আইটিও চত্বর।
কিসান ইউনিয়ন: পাঞ্জাব কিসান ইউনিয়নের নেতা রুলদু সিংহ মনসা মনে করেন উত্তেজনাবশত অল্পবয়সি ছেলেরাই এই কা- ঘটিয়ে ফেলেছেন। তিনি বলেন, ‘অল্পবয়সি কৃষকরাও আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। মূলত পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা থেকেই এসেছেন ওরা। লালকেল্লা এবং আইটিও পৌঁছে গিয়েছেন সকলে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। নির্ধারিত পথ ধরে মিছিল নিয়ে যেতে অনুরোধ করব। আমরা শান্তি বজায় রেখে চলেছি। এখনও সীমানায় আটকে রয়েছে বহু ট্র্যাক্টর।’
কি বলছে স্থানীয় গণমাধ্যম :প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ মিটে যাওয়ার পরই ট্রাক্টর মিছিল ঘিরে তেতে ওঠে রাজধানী। লাঠিচার্জ করে, জলকামান দেগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু তাতে সংঘর্ষ আরও চরমে ওঠে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মীও আহত হন। রাজধানীর সর্বত্র যাতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে না পারে, তার জন্য পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে মধ্য দিল্লিতে ঢোকার সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।