#ভারতের উপহারের ২০ লাখ ডোজ টিকা পেল বাংলাদেশ
#হাসিনা-মোদির সুসম্পর্কের উপহার এ টিকা
#সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয় ভারত
ভারত থেকে উপহার হিসেবে পাঠানো করোনা ভাইরাসের ২০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিশেষ ফ্লাইটে টিকার এই চালান গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। এরপর দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের হাতে টিকার দুটি বক্স তুলে দিয়ে হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন ভারতের হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী। বহুল আকাক্সিক্ষত করোনা ভাইরাসের এ টিকার চালান পৌঁছার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ করোনামুক্তির মহাযজ্ঞে প্রবেশ করলো। টিকা পৌঁছার খবরে দেশের সব স্তরের মানুষের মাঝে স্বস্তি ও সন্তোষ লক্ষ করা গেছে।
আব্দুল বারী নামের যাত্রাবাড়ী এলাকার ব্যবসায়ী, যার বয়স আনুমানিক ৬৫, তিনি তার ভাষায় ভোরের পাতাকে বলেন, ‘অনেকদিন ধরেই তো শুনতেছি করোনার টিকা আসতেছে। আবার মাঝখানে শুনলাম, টিকা নিয়া কি সব ঝামেলা হইতেছে। কিন্তু আজ যখন টিভিতে দেখতেছিলাম, ভারত থেকে উপহার হিসাবে ২০ লাখ টিকা আসছে দেশে, তখন খুব খুশি লাগছে। মনে হইছে, করোনায় দেশকে আর ভুগতে হবে না।’ বাড্ডার শাহিদা সুলতানা নামের এক ব্যাংকার জানান, এত দ্রুত বাংলাদেশ করোনার টিকা পেয়ে যাবে, সেটা ভাবতেও পারিনি। এখনো তো দেশের কেনা টিকা আসেনি। এসেছে উপহারের টিকা। যা-ই আসুক টিকা যে দেশের মাটি স্পর্শ করলো তাতেই মনে হচ্ছে মাথার উপর দিয়ে একটা বিশাল শঙ্কার মেঘ সরে গেল।’ দেশের বয়ঃবৃদ্ধ যাদের ইমিউনিটি কম, তাদেরই আগে এ টিকা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন শাহিদা সুলতানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান বলেন, ‘দেশে করোনার টিকা আসবে কি আসবে না- এ নিয়ে বিভিন্ন মহল নানা অপপ্রচার চালিয়েছিল। এমন কি এখনো টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে চলছে নানা প্রচারণা। কিন্তু এত দ্রুত সময়ে বিশ্বে করোনার টিকা উদ্ভাবন হয়েছে সেটা কি কম কথা?’ তিনি বলেন, একটা নতুন টিকার তো নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবেই। যারা উৎপাদক তারাও জানিয়েছে শতকরা ৯৫/৯৬ ভাগ কার্যকর এসব টিকা। তার মানে টিকা নেওয়ার পর কিছুটা সমস্যা হবেই। এসব সমস্যা বিপুল সংখ্যক মানুষের অক্ষত থাকার তুলনায় খুবই নগণ্য। কিন্তু কিছু মানুষের দেখা যাচ্ছে সমস্যা নিয়েই বেশি মাথাব্যথা, সম্ভাবনা নিয়ে নয়। ইশরাত দাবি জানান, শিক্ষার্থীদের আগে দেওয়া হোক করোনার টিকা। কারণ দেশে সব কাজ ঠিকই চলছে কিন্তু বন্ধ হয়ে আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের জীবনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে বলেই এই মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। টিকা প্রদানের ক্ষেত্রেও সরকার একই অবস্থানে থাকবে, এ প্রত্যাশাই করবো।
এদিকে উপহারের ২০ লাখ টিকা ছাড়াও আগামী ২৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশে আসার কথা রয়েছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ‘কোভিশিল্ড’র প্রথম চালান। মাসে প্রতি চালানে ৫০ লাখ ডোজ করে টিকা পাবে বাংলাদেশ। মোট তিন কোটি ডোজ টিকা কেনা হয়েছে সেরাম থেকে। গতকাল উপহারের টিকা পাঠিয়েই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর এক টুইটে বলেছেন ‘ভ্যাকসিন মৈত্রীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সর্বাধিক অগ্রাধিকার পুনর্ব্যক্ত করেছে ভারত।’ এর আগে ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী যখন বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে টিকা হস্তান্তর করছিলেন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সেসময় উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. জাহিদ মালেক, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম প্রমুখ। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার এই টিকা পৌঁছে যাওয়ায় দ্রুতই দেশে টিকাদান শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য অধিদফতর আগেই জানিয়েছে, আগামী ২৭ থেকে ২৮ জানুয়ারি টিকা প্রয়োগ শুরু হতে পারে। প্রথম দিনে ২০ থেকে ২৫ জনের উপর তা পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হবে। প্রথম দিন চিকিৎসক, নার্স, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, সাংবাদিকদের একজন করে প্রতিনিধিকে টিকা দেওয়া হবে। এরপর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে শুরু হবে সর্বত্র করোনাভাইরাস টিকা প্রদান। দেশের অন্তত ৯ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার।
হাসিনা-মোদির সুসম্পর্কের উপহার এ টিকা :ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুসম্পর্কের কারণেই ২০ লাখ টিকা এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। গতকাল দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ভারতীয় টিকা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, আজ ঐতিহাসিক একটি দিন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে যেভাবে সহায়তা করেছিল, করোনা মহামারির এই বিপদেও তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। এই টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হলো। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, ভারত প্রতিবেশী দেশের পাশে দাঁড়াতে চায়। ভারতে টিকা বিতরণের মাত্র চার দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ টিকা পেয়েছে। দুই দেশ একযোগে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করবে।
যাদের দরকার তারা আগে পাবে ভ্যাকসিন :যাদের দরকার তারাই আগে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন পাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল বেলা পৌনে ১২টার দিকে আজিমপুরে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি একথা জানান। জাহিদ মালেক বলেন, করোনার মধ্যে মানুষকে আমরা সেবা দিতে পেরেছি। যে কারণে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের মৃত্যু হার সবচেয়ে কম। করোনায় সংক্রমণের হারও কম। করোনায় আমরা ভালো করে সেবা দিতে পেরেছি, যেটা ইউরোপ-আমেরিকাও পারেনি। ইনশাল্লাহ ভ্যাকসিনও আমরা ভালোমত দিতে পারবো। আপনারা কোনরকম গুজবে কান দেবেন না। আগে আমরা সাধারণ মানুষকে ভ্যাকসিন দেবো। যাদের দরকার তারা আগে পাবে ভ্যাকসিন।
প্রতিদিন দেওয়া হবে দুই লাখ ডোজ টিকা :শুরুতে ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে টিকাদান শুরুর পরিকল্পনা হলেও উপহারের টিকা আগে আগে পাওয়ায় প্রয়োগের সময়ও এগিয়ে আনা হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে দুটি ফ্রিজার ভ্যানে করে টিকার বাক্স নিয়ে রাখা হয়েছে তেজগাঁওয়ে ইপিআই স্টোরেজে। সেখান থেকে কিছু টিকা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নিয়ে উপহার গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা সারা হয়। ইউপিআই’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার গোলাম মাওলা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই স্টোরেজের তাপমাত্রা মাইনাস ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। সে কারণে এই টিকা এখানে রাখা যাবে।’ স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ডা. রওশন জাহান আক্তার আলো জানান, মোট ১৬৭টি কার্টনে ২০ লাখ চার হাজার ডোজ টিকা এসেছে ভারত থেকে। ভ্যাকসিন ইপিআই সেন্টারে সংরক্ষণের সময় ইপিআইয়ের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাওলা বক্স, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম, তেজগাঁও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. বুলবুল উপস্থিত ছিলেন।
১২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের যেকোনো স্থানে নেওয়া যাবে টিকা :ঢাকা জেলার ইপিআই স্টোরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাওলা বক্স চৌধুরী বলেছেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধের ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য আমাদের কোল্ড বক্স আছে, সেখানে ২৪টি আইস প্যাক দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেই কোল্ড বক্সে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভ্যাকসিন রাখা যায়। দেশের যেকোনো জায়গায় যদি এই ভ্যাকসিনটি পরিবহন করি, তবে ১২-১৮ ঘণ্টার মধ্যে সবচেয়ে দূরে যে জেলাটি আছে পঞ্চগড় অথবা কক্সবাজারে যাওয়া যাবে। যদিও আমাদের হাতে আছে ৭২ ঘণ্টা। তিনি বলেন, এই ভ্যাকসিন পরিবহনের ক্ষেত্রে সড়কের সব স্থানে ইনফরমেশন দেওয়া থাকে। যদি ফেরি পারাপারের বিষয় থাকে তবে সেখানেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের (পুলিশ, জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন) ইনফরমেশন দেওয়া থাকবে। ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য সারা দেশেই ব্যবস্থা আছে বলেও জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, কতগুলো ভ্যাকসিন পেয়েছি, তার কাগজ এখনও আমি হাতে পাইনি। তবে ২০ লাখ ভ্যাকসিন আসার কথা রয়েছে। আমি এই ভ্যাকসিনগুলো গণনা করবো, তারপর সংখ্যাটি বলতে পারবো। ই পি আই স্টোরের টেম্পারেচার বিষয়ে ডা. মাওলা বক্স বলেন, ই পি আই স্টোরে টেম্পারেচার ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হবে না। কারণ এখানের টেম্পারেচার আমরা হেড অফিস থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এখানে রিমোট কন্ট্রোল টেম্পারেচার মনিটরিং ডিভাইস আছে। এছাড়াও আমাদের ফ্রিজট্যাগ আছে। ফ্রিজট্যাগ দিয়ে আমরা গত দুই মাস আগের টেম্পারেচার দেখতে পারি।