করোনা ভাইরাসের টিকা প্রথমবারের মত বাংলাদেশে আসছে আজ। উপহার হিসাবে পাঠানো ভারতের এই টিকা পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে দেশে শুরু হবে টিকার মহাযজ্ঞ। ভারতের সেরাম থেকে কেনা করোনা ভাইরাসের টিকা আসার কথা ২৫ জানুয়ারি মধ্যে।
তার আগেই ভারত উপহারস্বরূপ পাঠাচ্ছে ৩৫ লাখ ডোজ টিকা; যেগুলো আজ পৌঁছানোর কথা। উপহার হোক বা কেনা হোক, টিকার প্রথম চালান বাংলাদেশে প্রবেশের মধ্য দিয়ে মূলত দেশ করোনা মুক্তির প্রথম ধাপে পা দিলো। স্বাস্থ্য অধিদফতর আগেই জানিয়েছে, আগামী ২৭ থেকে ২৮ জানুয়ারি টিকা প্রয়োগ শুরু হতে পারে। প্রথম দিনে ২০ থেকে ২৫ জনের উপর তা পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হবে। প্রথম দিন চিকিৎসক, নার্স, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, সাংবাদিকদের একজন করে প্রতিনিধিকে টিকা দেওয়া হবে। এরপর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে শুরু হবে সর্বত্র করোনাভাইরাস টিকা প্রদান।
স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, দেশের অন্তত ৮ থেকে ৯ কোটি মানুষকে যেন টিকা দেওয়া যায়, সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এতে করে দেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে। টিকা প্রদানের মাধ্যমে করোনা মোকাবিলার এই সংগ্রামের সূচনা হবে কাল (আজ) থেকেই। আজ প্রতিবেশী দেশ ভারতের উপহার হিসেবে ২০ লাখ ভ্যাকসিন আসবে দেশে।
তিনি জানান, ভারত থেকে উপহারের ভ্যাকসিন গতকাল বুধবার আসার কথা থাকলেও ফ্লাইট বিলম্বের কারণে তা দেশে এসে পৌঁছাবে আজ। দুপুর দেড়টায় এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে এই ভ্যাকসিন আসবে। বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে এই ভ্যাকসিন গ্রহণ করবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও ভারতের হাইকমিশনারসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে আসবে বাংলাদেশের কেনা আরো ৫০ লাখ ভ্যাকসিন। প্রথম ধাপে ভ্যাকসিন কার্যক্রমের আওতায় আসবে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ। এভাবে ভারত থেকে আরও তিন কোটি ভ্যাকসিন পর্যায়ক্রমে আসবে। কোভ্যাক্স থেকে আসবে দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ অর্থাৎ ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য সচিব। টিকা নিয়ে এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে নানা জল্পনা কল্পনা।
যদিও অনেকেই সমালোচনা করছেন জনসংখ্যার শতভাগ টিকার আওতায় আনা হচ্ছে না কেন! এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সচিব জানিয়েছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী, যদি দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া যায়, তাহলে সে দেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়। সে হিসেবে সরকারের প্রথম পরিকল্পনার মাইক্রো প্ল্যানে টিকা দেওয়ার প্রস্তুতিতে এই ৮০ শতাংশ মানুষকে রাখা হয়েছে। মোট ৫ কোটি ১০ লাখের মানুষকে টিকা দেওয়ার পরেও যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে আমদানি করা হবে আরও টিকা।
এই মহাপরিকল্পনার মধ্যে আরো আশার কথা হল আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে দেশেই ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার সম্ভবনা আছে। সে আশার কথা শুনিয়েছেন গ্লোব বায়োটেকের ‘বঙ্গভ্যাক্স’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, রাশিয়া-চীনসহ কয়েকটি দেশ ছাড়াও একাধিক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন দিতে আগ্রহী। এদিকে প্রাইভেট হাসপাতাল বা বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে এখনই করোনার টিকা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে। করোনার টিকা দেওয়া হবে শুধু সরকারি হাসপাতালে। স্বাস্থ্য সচিব এ ব্যপারে বলেন, ‘প্রাইভেট হাসপাতালে করোনা ভাইরাসের টিকা নিয়ে যদি কারও মৃত্যু হয়, সে দায় সেই হাসপাতালের। সরকার সে দায় নেবে না।’ টিকা প্রদানের এই কার্যক্রম যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় সে জন্যে তৈরি করা হয়েছে করোনা অ্যাপ। এই অ্যাপের মাধ্যমে সেন্ট্রাল ডাটা পাওয়া যাবে সহজেই। এখান থেকে পাওয়া যাবে টিকাদানের সব তথ্য-উপাত্ত। আর টিকা দেওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত করা হবে স্বচ্ছতা। যাতে করে সঠিকভাবে মানুষকে চিহ্নিত করে দেওয়া যায় টিকা। এই অ্যাপের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সুরক্ষা’। ইতোমধ্যেই করে ফেলা হয়েছে টিকা বিতরণের পরিকল্পনাও।
এদিকে রাজধানীর ৪ হাসপাতালে শুরু হচ্ছে করোনার টিকার মহড়া। এ মাসের মধ্যেই রাজধানীর কোন একটি করোনা হাসপাতালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে করোনার টিকার ‘ড্রাই রান’ বা পর্যবেক্ষণমূলক টিকাদান। তারপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী, অপেক্ষা করা হবে এক সপ্তাহ। তারপর টিকা নেওয়ার পরে তাদের মধ্যে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে কি না দেখা হবে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে টিকা বিতরণ শুরু হবে সারা দেশে। প্রথম দিন টিকা দেওয়া হবে প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মীর পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২০ থেকে ২৫ জনকে। প্রথম দিন টিকা দেওয়া হবে চিকিৎসক, নার্স, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, সাংবাদিকদের একজন করে প্রতিনিধিকে। ব্যাপকভাবে টিকাদান শুরুর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে টিকা দিয়ে সাত দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এ টিকা প্রদানের সম্ভাব্য দিন ঠিক করা আছে ২৭ অথবা ২৯ জানুয়ারি। তবে এখনও এটা চূড়ান্ত নয়।
টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে উদ্বোধন করার প্রাথমিক পরিকল্পনা আছে সরকারের। সরকারের কেনা এই টিকা জেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেবে বেক্সিমকো। আর ভারত সরকারের উপহার হিসেবে আসা টিকা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় পৌঁছানো হবে জেলা পর্যায়ে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি টিকা দেওয়া হবে জেলা-উপজেলা এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। টিকা প্রদানের এ প্রক্রিয়ার কথা নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান গতকাল বলেছেন, ‘উপহার হিসেবে পাওয়া টিকা ঢাকায় কোল্ড চেইনে আমরা রাখার চেষ্টা করছি। ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনদের কাছে পাঠানো হবে। এটা ইপিআই কর্মসূচির আওতায় যেভাবে টিকা পাঠানো হয়, সেভাবে পৌঁছে দেওয়া হবে।’