প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২১, ২:১৭ এএম আপডেট: ১৯.০১.২০২১ ১:০৪ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে পিপলস লিজিংয়ের পরিচালকরা টাকা লুটপাতে জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন আমানতকারীরা। ব্যাংকের ডিজিএম আমজাদ হোসেনসহ কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ২০১৫ সাল থেকে পিপলস লিজিংয়ে সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকার পরও সেখান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা। আমানতকারীদের এই অভিযোগের পরও পিপলস লিজিংয়ের পরিচালকদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বরং পরিকল্পিতভাবে পিপলস লিজিংকে অবসায়নের পথে নিয়ে গিয়ে হাজার হাজার আমানতকারীকে ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তার মাঝে। ফলে এসব লুটপাটের দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছেন আমানতকারীরা। গতকাল সোমবার রাজধানীর মতিঝিলে সিটি সেন্টারের সামনে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফসিএল) ক্ষুদ্র আমানতকারীদের উদ্যোগে আয়োজিত এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তারা এসব কথা বলেন।
মানববন্ধন কর্মূসূচিতে বক্তব্য রাখেন পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানি ব্যক্তি আমানতকারীদের কনভেনার ও প্রধান সমন্বয়কারী মোহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিক, সেক্রেটারি জেনারেল রানা ঘোষ, আমানতকারী সানিয়া বিনতে মাহবুব, তারেখসহ কয়েকশ ক্ষুদ্র আমানতকারী উপস্থিত ছিলেন। মানববন্ধন শেষে আমানতকারীরা মিছিল নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যালয়ে গিয়ে একটি স্মারকলিপি দেন। মানববন্ধন কর্মসূচিতে আমানতকারীরা বলেন, পিপলস লিজিং বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান এবং পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি। ১৯৯৩ সালের বাংলাদেশ সরকারের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ডিন্যান্স ও নীতিমালা অনুযায়ী পিপলস লিজিংয়ের সঠিক তদারকির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তার সঠিক দায়িত্ব পালনে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডিজিএম আমজাদ হোসেনসহ কিছু কর্মকর্তা পিপলস লিজিংয়ে রাখা আমানতকারীদের অর্থ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা যেন লুটপাট করতে পারেন, সে সুযোগ করে দিয়েছেন।
তারা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঠিক তদারকি না থাকায় এবং তাদের ব্যর্থতার কারণে ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়ন করা হয়েছে। এতে করে ৬ হাজার ব্যক্তিশ্রেণির আমানতকারীর হাজার কোটি টাকা আটকে পড়েছে। তারা আমানতের টাকা তুলতে না পেরে অনাহারে-অর্ধহারে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মরতে বসেছেন। অনেকের ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। এরই মধ্যে আমানতের টাকা ফেরত না পাওয়ার শোকে ছয়-সাত জন আমানতকারী মৃত্যুও বরণ করেছেন। মোহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিক বলেন, অনেক মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, প্রবাসীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের সারা জীবনের সঞ্চয় এখানে আমানত রেখেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা, অদক্ষতা ও ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতির কারণে পিপলস লিজিং অবসায়ন করতে হয়েছে। বর্তমানে আমানতের টাকা ফেরত না পেয়ে আমানতকারীরা মানবেতর জীবনযাপন করেছেন।
আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আমানতের টাকা ফেরত না পেলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমানতকারী সামিয়া বিনতে মাহবুব জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে পিপলস লিজিংয়ের টাকা লুটপাট হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্বাহী পরিচালক আমজাদ হোসেন পিপলসের প্রশাসক হিসেবে অফিস করাকালীন পিপলসে টাকা রাখতে তাদের উৎসাহিত করেছেন। আমানতকারী তারেখ বলেন, সারাজীবনের সঞ্চয় এখানে রেখে আমি পথে বসেছি। আমার ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমানতকারী রানা রায়হান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানে কিভাবে লুটপাট হয়? বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগসাজশ ছাড়া এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। তিনি অবিলম্বে আমানতের টাকা ফেরত দেওয়ার দাবি জানান। এছাড়াও লিখিত বক্তব্য বলা হয়, পিপলসের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পিপলসের পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) একাই সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কানাডা পালিয়ে গেছে। তিনি কিভাবে পালিয়ে গেলেন? শুধু তাই নয়, পিপলস লিজিংয়ের টাকা আত্মসাৎ করে অনেকে এখনো দেশে ঘুরে বেড়ালেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এর আগে, ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর পিপলস লিজিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন পাওয়ার পর ২০০৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।
২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ছিল। ২০১৯ সালে ২১ মে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে পিপলসের অবসায়নের আবেদন করে। গত ২৬ জুন অর্থ মন্ত্রণালয় সে আবেদন অনুমোদন করলে ১০ জুলাই পিপলসের অবসানের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। একই বছরের ১১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিং থেকে টাকা তোলার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করে। ১৪ জুলাই বাংলাদেক ব্যাংকের ডিজিএম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানকে প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে ছয় হাজার ব্যক্তি শ্রেণির আমানতকারী এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর ১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা আটকে পড়েছে। এই টাকার পুরোটাই পিপলস ঋণ হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে। এর একটি বড় অংশ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।