ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্ম নির্ভর কনটেন্ট প্রকাশ ও পরিবেশনের ওপর তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব আদায়ে একটি নীতিমালা করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তথ্য সচিব ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যানকে আগামী তিন মাসের মধ্যে নীতিমালার খসড়া তৈরি করে আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিটিআরসি ও পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদন দেখার পর বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল সোমবার এ আদেশ দেয়। বিটিআরসির প্রতিবেদনটি দাখিল করেন আইনজীবী খন্দকার রেজা-ই-রাকিব। আর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপমহাপরিদর্শকের দেওয়া প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। রিটকারীর পক্ষে আদালতে শুনানি করেন আইনজীবী তানভীর আহমেদ।
আইনজীবী রেজা-ই-রাকিব পরে বলেন, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও কীভাবে রাজস্ব আদায় করা যায় সে বিষয়ে একটি নীতিমালা করার জন্য সরকার থেকে যে কমিটি করে দিয়েছে, সে কমিটিকে বলা হয়েছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে খসড়া নীতিমালা করে আদালতে দাখিল করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম যেসব ভিডিও কনটেন্ট প্রচার-পরিবেশন করা হচ্ছে, তাকে আইনের আওতায় আনার জন্য এবং তদারকি, নিয়ন্ত্রণসহ এসব মাধ্যম থেকে কীভাবে রাজস্ব আদায় করা যায়, তার জন্য নীতিমালা করতেই এ কমিটি করা হয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে অতিরিক্ত তথ্য সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের এই কমিটি করা হয়েছিল। বিটিআরসির মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি, এনবিআরের একজন প্রতিনিধি ছাড়াও আইনজীবী রেজা-ই-রাকিব আছেন সেই কমিটিতে।
রিটকারী আইনজীবী তানভীর আহমেদ বলেন, গত বছর একটি ইংরেজি দৈনিকে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। সে প্রতিবেদনে বলা হয়, নেটফ্লিক্স বছরে ১৮০ কোটি টাকা আয় করে বাংলাদেশের গ্রাহকদের কাছ থেকে। এরকম প্ল্যাটফর্ম এখন অনেকগুলো আছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে সরকার রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। তাছাড়া অনেক ভিডিও কনটেন্ট এসব প্ল্যাটফর্মে ছাড়া হচ্ছে, যা আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সাথে যায় না। ফলে এর তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সেজন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন। সে কারণে আদালত এ আদেশ দিয়েছেন। ওটিটি-নির্ভর বিভিন্ন ওয়েব প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ‘অনৈতিক ও আপত্তিকর’ ভিডিও কনটেন্ট পরিবেশন রোধে ‘নিষ্ক্রিয়তা’ চ্যালেঞ্জ করে গত বছর ১২ জুলাই হাইকোর্টে রিট আবেদনটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানভীর আহমেদ। ওইসব প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণ-তদারকিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা চাওয়া হয় সেখানে। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গতবছর ১৫ জুলাই আদালত ওটিটি-নির্ভর বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে ‘অনৈতিক ও আপত্তিকর’ কনটেন্ট সরাতে সাত দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে এক মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়।
সেই সঙ্গে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে দেশে ‘অনৈতিক ও আপত্তিকর ভিডিও কনটেন্ট’ পরিবেশনের বিষয়ে অনুসন্ধান করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। তখন আদালত বলে দেয়, এরপর রিট আবেদনটি নিয়মিত বেঞ্চে উপস্থাপন করতে হবে। সে অনুযায়ী গত বছর আগস্টে আবেদনটি নিয়মিত বেঞ্চে উপস্থাপন করা হয়। ৮ সেপ্টেম্বর শুনানির পর আদালত রুল জারি করে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে ‘অনৈতিক ও আপত্তিকর’ ভিডিও কনটেন্ট পরিবেশন রোধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন ‘বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। সেই সঙ্গে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তদারকির জন্য নীতিমালা প্রণয়নে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব, তথ্যসচিব, সংস্কৃতিসচিব, বিটিআরসির চেয়ারম্যানসহ আট বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। এর ধারাবাহিকতায় বিটিআরসি ও পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, যা সোমবার হাইকোর্টে উপস্থাপন করা হয়।
বিটিআরসির প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সাথে বিটিআরসির কোনো চুক্তি হয়নি এবং আন্তর্জাতিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো বিটিআরসির লাইসেন্সপ্রাপ্তও নয়। বিটিআরসি এসব ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে কোনো রাজস্ব সংগ্রহ করে না। ফলে আন্তর্জাতিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপর বিটিআরসির কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা আরোপের সুযোগ নেই। আর পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওটিটি নির্ভর এ ধরনের প্ল্যাটফর্মের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এসব প্ল্যাটফর্ম কোনো টেরিস্ট্রিয়াল চ্যানেল ব্যবহার না করে সরাসরি ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে কোনো ধরনের কনটেন্ট দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। ফলে একজন দর্শক কোনো ধরনের কেবল অথবা ডিশ অ্যান্টেনা ছাড়াই শুধু ইন্টারনেট এবং স্মার্ট টিভি/ফোন ব্যবহার করে এসব ওয়েব কনটেন্ট দেখতে পারে।
ফলে ওটিটি নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলো বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশেই দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলাদেশের বাইরে এ ধরনের বেশ কিছু বিখ্যাত ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, জিফাইভ, হটস্টার, আড্ডা টাইমস এবং হইচই। এর বাইরেও শত শত আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। এসব প্ল্যাটফর্মে যে কোনো দেশের জনগণ সাবস্ক্রিপশন কেনার মাধ্যমে কনটেন্ট দেখতে পারে। সুতরাং এ ধরনের শত শত ওটিটি নির্ভর প্ল্যাটফর্মের হাজার হাজার কনটেন্ট রয়েছে, যাতে এমন অনেক অনৈতিক বক্তব্য, ছবি ও ভিডিওর ব্যবহার রয়েছে, যা আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৬৯(ক), (খ) এবং ৭৮ ধারার উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ সরাসরি এ ধরনের ঘটনা অনুসন্ধান বা তদন্ত করতে পারে না।
একমাত্র কমিশনের লিখিত অনুমোদন সাপেক্ষে পুলিশ তদন্ত করতে পারে। তবে সাইবার পুলিশ সেন্টারের সাইবার মনিটরিং টিম সোশাল মিডিয়া, অনলাইন মিডিয়ার পাশাপাশি এসব ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওপরও নিয়মিত নজর রাখছে জানিয়ে পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইবার পুলিশ তাদের নিকট এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ, মামলা অথবা উপরেল্লিখিত কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে দ্রুত উপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্মিত যে কোনো চলচ্চিত্র প্রচার বা প্রদর্শনের আগে জাতীয় সেন্সর বোর্ডের অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ছাড়াও কেবল টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ- তা দেখার জন্য ‘কার্যকর কোনো কর্তৃপক্ষ’ নেই। এ ধরনের যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ থাকলে এ ধরনের সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।