প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২১, ২:১৭ এএম আপডেট: ১৯.০১.২০২১ ১:০৭ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা। বাইরে নির্বাচনী আমেজ। ওয়ার্ড জুড়ে বইছে আনন্দের সু-বাতাস। বিজয়ী কাউন্সিলর তরিকুল ইসলাম খানের গলায় মালা পড়ানোর প্রস্তুতিও চলছে পুরোদমে। স্ত্রী আর দুই সন্তান তখন গভীর প্রার্থনায় মগ্ন। ঠিক এমনই সময় নিজ মহল্লাসহ পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে নবনির্বাচিত কাউন্সিলর তরিকুলকে তার প্রতিপক্ষরা খুন করেছে। এমন সংবাদ শুনে এক নিমেষেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তাদের উপর। প্রিয় স্বামীকে হারিয়ে পাথর হয়ে গেছেন স্ত্রী হাসি খাতুন। বাকরুদ্ধ হয়ে পরেছেন ছেলে একরামুল হাসান হৃদয় ও মেয়ে তাহিদা জাহান তিজা। হাসি তার স্বামী হারিয়ে এবং সন্তানরা বাবা হারিয়ে শোকের সাগরে ভাসছেন।
এদিকে, এমন মৃত্যুকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না নিহতের পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রোববার দুপুরের পর নিহত তরিকুলের ছেলে একরামুল হাসান হৃদয় বাদী হয়ে পরাজিত কাউন্সিলর প্রার্থী সাহেদনগর ব্যাপারীপাড়া মহল্লার বাসিন্দা ও ৬নং ওয়ার্ড আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন বুদ্দিনকে প্রধান আসামি করে ৩২ জনের নাম উল্লেখপূর্বক ৪০/৫০ অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে একটি অভিযোগ দাখিল করেছে বলে নিশ্চিত করেছে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
সদর থানার ডিউটি অফিসার এসআই শাহিন জানান, অভিযোগটি পেয়েছি। ওসি সাহেব বাইরে আছেন। তিনি এসে অভিযোগ দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। রোববার সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, গত শনিবার রাত সাড়ে ছয়টার দিকে দ্বিতীয় ধাপের পৌর নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের শহীদগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বুদ্দিন তার সমর্থকদের নিয়ে ভোটের ফল প্রকাশে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে এমন খবরেরভিত্তিতে তরিকুল সেখানে হাজির হয়। পরে ফলাফলে বেসরকারিভাবে ৮৪ ভোটে নির্বাচিত হন ডালিম প্রতীকের প্রার্থী তরিকুল ইসলাম খান। এসময় আগে থেকে অবস্থান নেওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বুদ্দিন তার পরাজয় সইতে না পেরে তৎক্ষণাত ধারালো অস্ত্র দিয়ে তরিকুলের পেটে আঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে সিরাজগঞ্জ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। এ হত্যাকা-রে ঘটনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং সাহেদনগর ব্যাপারীপাড়া এলাকায় হামলা চালিয়ে একটি বাড়িতে আগুন দিয়ে দুটি ট্রাক, একটি প্রাইভেট কার ও পাঁচটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। এসময় আরও তিনটি বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার জেরে রোববার কয়েক দফায় বিক্ষোভ মিছিল করে এলাকাবাসী।
গতকাল সকালে নিহত তরিকুলের নতুন ভাঙ্গাবাড়ি মহল্লার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তরিকুলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও অভিযুক্ত ৬নং ওয়ার্ড আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন বুদ্দিনসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে দফায় দফায় মিছিল করছে এলাকার হাজারো নারী-পুরুষ। এসময় কথা হয় নতুন ভাঙ্গাবাড়ি মহল্লার বাসিন্দা ও জেলা আ.লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন জুয়েরের সঙ্গে। তিনি জানান, নিহত তরিকুল গ্রাম পঞ্চায়েতের সাধারণ সম্পাদক, মাদরাসা-মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক, ঈদগাহ মাঠের সাধারণ সম্পাদক, রহমতগঞ্জ কবরস্থান কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তাছাড়া তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীও ছিলেন। সম্প্রতি পৌর আ.লীগ নেতৃবৃন্দের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে আ.লীগে যোগদান করেন তিনি। এর আগে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার বাবা সাবেক পৌর কমিশনার মরহুম আব্দুল কুদ্দুস খান ছিলেন ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। ন¤্র, ভদ্র ও সততার কারণে এলাকায় তরিকুল ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। যে কারণে এবারের নির্বাচনে নতুন ভাঙ্গাবাড়ি থেকে আরও দুজন কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিলেও পঞ্চায়েত কমিটি বসে তাকে কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে। তার এমন মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায়না। এসময় ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি। বর্তমান কাউন্সিলর শাহাদৎ হোসেন জানান, তরিকুলের মতো ভালো ছেলে সচরাচর পাওয়া যায় না। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি গরিব-দুঃখী মানুষের আপদে-বিপদে পাশে থাকতেন। তাকে হারিয়ে আমরা বাকরুদ্ধ।
সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম (বিপিএম) বলেন, এ হত্যা ঘটনার পর রবিবার সকালে ঘটনাস্থল শহীদগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র এলাকা পরিদর্শন করেন রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি টিএম মোজাহিদুল ইসলাম। এর আগে নিহতের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের শান্তনা দিয়ে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন তিনি। তার নির্দেশে দু’জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ডিবির ওসির সমন্বয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। সাত কার্য দিবসের মধ্যে এ তদন্ত টিম চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। এ ছাড়া, হত্যাকা-ে জড়িতদের শনাক্ত করা হয়েছে। অতিদ্রুতই তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এদিকে, রোববার বাদ জোহর নতুন ভাঙ্গাবাড়ি মসজিদ মাঠে কয়েক হাজার মুসল্লির অংশগ্রহণে নিহত তরিকুলের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজায় উপস্থিত ছিলেন- জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ, পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম, পৌর মেয়র সৈয়দ আব্দুর রউফ মুক্তা, জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ তালুকদার, পৌর আ’লীগের সভাপতি হেলাল উদ্দিন প্রমুখ। এসময় পৌর আ.লীগের সভাপতি হেলাল উদ্দিন উপস্থিত নৃতৃবেন্দের সাথে কথা বলে ৬নং ওয়ার্ড আ.লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে শাহাদৎ হোসেন বুদ্দিনকে দল খেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন।