এবার ঢাকাবাসীর কপাল খুলছে। মিলতে পারে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি। দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর খালগুলো সিটি করপোরেশনের অধীনে না থাকায় এসব খাল দখল ও ময়লায় সয়লাব ছিল। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার অর্থাৎ বিদায়ী বছরে শেষ দিনে একটি সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বুঝে পায় দুই সিটি করপোরেশন। নতুন বছরের প্রথম দিনেই এই সুসংবাদ পায় রাজধানীবাসী। আর দুই সিটি দায়িত্ব বুঝে পেয়েই লেগে গেছে খালগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার কাজে। এতেই খুশি রাজধানীর মানুষ।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সূত্র জানায়, গতকাল শনিবার থেকেই নিজের সীমানায় অবস্থিত সব খাল ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কার করা এবং বেদখল হয়ে যাওয়া খাল উদ্ধারে অভিযানে নেমেছে। প্রাথমিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি খাল ও দুটি বক্স কালভার্ট পরিষ্কারে নেমেছে তারা। এগুলো হলো- জিরানি খাল, মা-া খাল ও শ্যামপুর খাল এবং পান্থপথ বক্স কালভার্ট ও সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট। জানা গেছে, খাল তিনটির দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটার। আগামী মার্চ মাসের মধ্যেই এসব খাল ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কার করা হবে ও উদ্ধার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। এগুলো পরিষ্কার করতে পারলে আগামী জুন মাস নাগাদ সব খালকে পর্যায়ক্রমে পরিষ্কার করা ও সম্পূর্ণ অবৈধ দখলমুক্ত করা হবে।
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, গতকাল সকালে রাজধানীর পান্থপথ সড়কের পান্থকুঞ্জ পার্কের বক্স কার্লভার্ট পরিষ্কারের মাধ্যমে খাল উদ্ধার, পরিষ্কার এবং রক্ষাণাবেক্ষণের কার্যক্রম শুরু করেছে তারা। পরিষ্কার কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘মেয়র নির্দেশ নিয়েছেন। আমরা কোনো বিলম্ব না করে কাজ শুরু করেছি। আশা করছি আমরা সফল হবো। আমরা যাতে এপ্রিলের শুরু থেকে ঢাকা শহরকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে পারি সে পরিকল্পনা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, এপ্রিলের মধ্যে আমরা তিনটা খাল এবং দুইটা কালভার্ট সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করতে পারব। যদি এ সময়ের মধ্যে খাল এবং কালভার্ট পরিষ্কার করতে পারি, তাহলে আমরা বিশ্বাস করি, এ বছর জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাব।’ তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক পরিচ্ছন্নতা কাজ, এরপর সীমানা নির্ধারণ কাজ, তারপর সেগুলো উচ্ছেদ কার্যক্রম শেষ করে আমরা ওখান থেকে বর্জ্য অপসারণ করব। আজ আমরা কাজ শুরু করলাম, দেখি ভেতরে কি আছে। এর ওপর নির্ভর করে আমরা আমাদের পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণ করব।’
এ সময় ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. বদরুল আমিন বলেন, ‘পান্থকুঞ্জ পার্কের ভেতরে যে বক্স কালভার্ট রয়েছে। সেটির গভীরতা দুই রকম আছে। ১১ ফিট থেকে ২০-২২ ফিট আছে। আমরা সঠিক মাপটা বের করব।’ এছাড়া তিনি জানান, পান্থপথ খালের মোট ২৪টি মুখ রয়েছে। এরমধ্যে প্রথম দিনেই তিনটি মুখ পরিষ্কারে কাজ শুরু করেছে। কেবল মুখ পরিষ্কার করাটা খালের পানি প্রবাহে কতটা ফলপ্রসূ হবে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘কার্লভার্টের মুখ পরিষ্কার করলে হবে না। ভেতরে লোক প্রবেশ করাতে হবে। মেশিন প্রবেশ করাতে হবে। ক্রেন প্রবেশ করাতে হবে। প্রেসার দিয়ে পানি দিতে হবে। আমরা দেখলাম অনেক কানেকশন বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা ২০০ মিটার করে আগাবো।’
ওয়াসা থেকে যন্ত্রপাতি এবং জনবল সহযোগিতা নিয়ে কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার ওয়াসার সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী আমরা ওয়াসার যন্ত্রপাতি, ওনাদের যে নলেজ সেটাও পাব। আমাদের যে প্রকৌশলীরা রয়েছেন, তারা সেটা বুঝে নিচ্ছেন।’ জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে গুচ্ছ পদ্ধতিতে এ অভিযান চলবে একটানা তিন মাস। পান্থপথের পর মতিঝিল টিটি পাড়া থেকে সেগুনবাগিচা পর্যন্ত তৈরি করা বক্স কালভার্ট পরিষ্কারে নামবে ডিএনসি। মূলত আগামী বর্ষার আগেই রাজধানীর সব খালের পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করে সম্পূর্ণ সচল করতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর সায়েদাবাদের বাসিন্দা রাগিবুল হাসান বলেন, শুনেছি জিরানি খাল পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়েছে। এ খালে যে পরিমাণ বর্জ আটকে থাকে তাতে এর পানি প্রবাহ নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। ফলে প্রতিবছর বর্ষার মওসুমে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে থাকে। হাঁটু পানি পার হয়ে এখানকার বাসবাড়ির লোকজনকে যাতায়াত করতে হয়। মানিকনগরের বাসিন্দা তৌফিকুল ইসলামও একই কথা বলেন। তিনি ডিএনসিসির এ উদ্যোগে যারপনাই আনন্দ প্রকাশ করেন। বলেন, ‘তাইলে এবার আমাগে কপাল খুইলা যাইবো। বহুত দিন জলাবদ্ধতায় কষ্ট পাইছি।’
আবর্জনা ফেলে, অবৈধ দখলের মাধ্যমে বহু বছর ধরে রাজধানীর খালগুলোর প্রবাহমানতা নষ্ট করা হয়েছে। তিলোত্তমা এ নগরীর ৪৭ খালের মধ্যে এখন টিকে আছে ২৬টি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাল উদ্ধারে মহাপরিকল্পনা করে দিলেও এসব উদ্ধারে দীর্ঘদিন কোনো গতি ছিল না। গত কয়েক বছরে সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আবদ্ধ খালগুলোকে মুক্ত করা এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে এসব খালে প্রাণ ফেরানোর বিষয়টি উঠে আসে আলোচনায়। কিন্তু বারবার খাল উদ্ধারে সরকারের এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপিয়ে গা বাঁচিয়ে চলেছে। দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকা ওয়াসা থেকে খালগুলো নিজেদের কর্তৃত্বে আনতে চাইছিল দুই সিটি করপোরেশন। অবশেষে সেটি সম্ভব হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার হিসাব মতে বর্তমানে ঢাকা মহানগরীতে ২৬টি খাল রয়েছে। যেসব খালের ওপর ওয়াসা ড্রেন নির্মাণ করেছে সেগুলোর প্রস্থ ২০ থেকে ৪০ ফুটের মধ্যে। অথচ ঢাকার অনেক খালের প্রস্ত ১২০ থেকে ১৮০ ফুট পর্যন্ত ছিল। খালের বাকি জমিগুলো কোথায় গেছে এ নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠেছে। ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট নামের একটি সংস্থা রাজধানীর সবগুলো খাল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায় যে খালগুলো উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলোও সরু ড্রেনে রূপ দিয়েছে ওয়াসা। প্রকৃতপক্ষে খালের জমি খালকে ফেরত দেয়া হয়নি। এতে করে সরু ড্রেনে জল ধারণ ক্ষমতা কম হওয়াতে একটু বৃষ্টিতেই রাজধানী ভাসে যাচ্ছে।