নিয়োগ বিধিমালার গ্যাঁড়াকলে পড়ে চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনস্থ বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরা। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে বিদ্যমান ৩৪টি বিষয়ের মধ্যে সিভিল, ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল ছাড়া বাকি ৩১টি বিষয়ের ডিপ্লোমাধারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন বিভিন্ন নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে।
বৈষম্যমূলক মানসিকতা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং নানা প্রশাসনিক জটিলতায় পড়ে শিক্ষা শেষে অনিশ্চিত জীবন কাটাতে হচ্ছে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ও সক্ষম একটি জনশক্তিকে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিলের সরকারি কর্ম কমিশনের (নন ক্যাডার) উপসহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিকে ঘিরে এসব তুঘলকি নজরে আসে। এ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আলোকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ২৩১৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে কনস্ট্রাকশন টেকনোলজির শিক্ষার্থী হওয়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে ৯৬ জন শিক্ষার্থীকে। অথচ এর পূর্বেকার সব নিয়োগেই এ বিষয়ের শিক্ষার্থীরা সমান সুযোগ পেয়েছে। হঠাৎ করে কারিগরি বোর্ডের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন বৈষম্য ও বিভাজন ক্ষুব্ধ করে তুলেছে বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের। সংশ্লিষ্ট অধিদফতর থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত ধরনা দিয়েও এর কোনো সুরাহা জোটেনি।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের চাকরি নিয়োগ প্রক্রিয়া ও তৎসংলগ্ন বিধিমালায়ও ভোগান্তিই শুধু নয় হচ্ছে একাডেমিক সিলেবাস বৈষম্যও। কনস্ট্রাকশন টেকনোলজি ২০০৫ থেকে চালু হলেও প্রকাশ করা হয়নি ১৯৮৩ সালের নিয়োগ বিধির কোন সংশোধন/প্রজ্ঞাপনও। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার আবেদন নিবেদন করেও মিথ্যা আশ^াস ছাড়া কিছুই পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ সময়েও মেলেনি স্থায়ী কোন সমাধান। আগের নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলোতে কারিগরি বোর্ড থেকে সমমান সনদ দেওয়া হলেও এ বছর মিলছেনা তাও।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ক্ষুব্ধ এবং লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা জানান, তারাও প্রকৌশলের শিক্ষার্থী। তাদের সনদে সিভিল কথাটি না থাকলেও তাদের পঠিত কনস্ট্রাকশন টেকনোলজির বিষয়গুলোর সাথে সিভিল টেকনোলজির মিল রয়েছে ১৫০ ক্রেডিট (৯৩.৭৫%)। শুধু, ১০ ক্রেডিট (৬.২৫%) কম থাকার কারণে তাদের প্রতি এই আচরণ করা হচ্ছে যা অগ্রহণযোগ্য। শুধু কিছু বিষয় কোড/বিষয়ের নাম ভিন্ন হওয়া এবং আধুনিক সিভিল বিষয়ক জ্ঞান থাকার পরও তাদের সাথে এই বৈষম্যমূলক আচরণের কোন যৌক্তিকতাই নেই বলে দাবি করেন তারা। এদিকে, স্বয়ং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডও কনস্ট্রাকশন টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। ভুক্তভোগীরা জানান, ১৫ বছর ধরে চলে আসছে এই বৈষম্য। এ নিয়ে ধর্না ও আন্দোলন দুই-ই চালাচ্ছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। তারা জানিয়েছেন, ১২ বছর ধরে এ নিয়ে মৌখিক ও লিখিতভাবে আবেদন নিবেদন করা হচ্ছে। কিন্তু এ সংকট নিরসনে কোন পদক্ষেপই নেয়নি কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। বারবার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সে আশ^াস বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। ফলে ভুক্তভোগীদের মাঝে ক্ষোভ দিনদিন বাড়ছে।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সরকারি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ডিপ্লোমা ইন সিভিল (পূর্ত) টেকনোলজির সাথে ডিপ্লোমা ইন কনস্ট্রাকশন (নির্মাণ) টেকনোলজি অন্তর্ভুক্ত করার প্রজ্ঞাপন জারী করার সুপারিশ করতে তারা বারবার বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু কোন সদুত্তর মেলেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানিয়েছেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের গত ৬ ডিসেম্বর স্মারক নম্বর ৫৭.১৭.০০০০.২০১.১৪.২০.১৬ এর চিঠিতে সিভিলের সাথে কনস্ট্রাকশন টেকনোলজি মিল দেখানো হয়েছে ৬২.৭৬৫% এবং অমিল দেখানো হয়েছে ৩৭.২৩৫%; যা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডেরই ১৮/০৭/২০১৮ইং তারিখের স্মারক বিটিইবি/ক/এম/২০১৮/১৮২ এর সাথেই সাংঘর্ষিক। উক্ত স্মারকের সমমান সনদে উল্লেখ করা আছে উভয় টেকনোলজি ৪ বছরের শিক্ষাক্রমে ৫০টি বিষয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করে ১৬০ ক্রেডিট এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ৩২ এবং ৩৪ ক্রেডিট। সে অনুপাতে উভয়ের মিল ১৬০-৩২:১৬০। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে, উভয় টেকনোলজির মিল ১৫০ ক্রেডিট (৯৩.৭৫%) আর অমিল শুধু, ১০ ক্রেডিট (৬.২৫%)।
এ বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ রূপক কান্তি বিশ^াস ভোরের পাতাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কারিকুলাম বিষয়ক দেওয়া তথ্যে গড়মিল আছে। তবে দাবিসমূহ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। শুধু কনস্ট্রাকশনই নয় আরো নতুন কিছু ডিপার্টমেন্ট চালু আছে। সেগুলোর বিষয়েও ভাবা হচ্ছে। স্থায়ী সমধানের বিষয়ে তিনি জানান, আজ রোববার এ সংক্রান্ত মিটিংয়ে বসবে বোর্ড।
শিক্ষার্থীদের ভবিষৎ কি হবে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে বোর্ডের ক্ষমতা সীমিত। এদিকে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডেও কারিকুলাম ডিরেক্টর প্রকৌশলী মো. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তারা কতদিন দাবি নিয়ে ঘুরছে আমার জানা নেই। আমি আড়াই মাস ধরে আছি। তিনি উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সমমান সনদের কথা উল্লেখ ছিল না বলে স্বীকার করেন। উক্ত পদে কনস্ট্রাকশনের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, সিভিলের ছাত্ররা বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশনের কাছে কনস্ট্রাকশনের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার বিপরীতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ায় এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।’ গত ৬ ডিসেম্বরের চিঠিতে বোর্ডের সিভিল ও কনস্ট্রাকশনের কারিকুলামের মিল ও অমিল প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা স্ব স্ব বিভাগের শিক্ষকদের সাথে বসেই নির্ধারণ করেছিলাম। ছাত্ররা কে কি বলছে তা আমার জানা নেই। বিগত নিয়োগগুলোতে দেওয়া বোর্ডের সমমান সার্টিফিকেটের সাথে ৬ ডিসেম্বরের চিঠির পার্থক্যের বিষয়ে কোন জবাব দেননি কারিকুলাম ডিরেক্টর।
এদিকে শিক্ষার্থীদের দাবি বোর্ডের কারিকুলামের মিল ও অমিল সংক্রান্ত আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন না তাদের বিষয়ের শিক্ষকরা। বিদায়ী বছরের ২১ ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও ১ টায় কারিগরি অধিদফতরের ভবনের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন কনস্ট্রাকশনের শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা ৭ দিনের আলটিমেটাম দিলেও কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।
মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা ৬টি দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো ১. বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক সব নিয়োগ কার্যক্রমে যাতে সিভিলের সাথে কনস্ট্রাকশন টেকনোলজি বাধাহীনভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে অনতিবিলম্বে সে ব্যবস্থা করতে হবে। ২. বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা নিরসন দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ৩.বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চলমান সার্কুলারের মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। ৪. অবিলম্বে নিয়োগবিধি সংশোধন করে সিভিলের সাথে কনস্ট্রাকশন টেকনোলজি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ৫. উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে কনস্ট্রাকশন টেকনলজির নিয়োগ চাই। ৬. শুধু বিষয় কোড/বিষয়ের নাম বিবেচনা না করে, কোর্স কারিকুলাম এবং সিলেবাস অনুযায়ী সিভিলের সাথে কনস্ট্রাকশন টেকনোলজির তুলনামূলক সাদৃশ্য নিরূপণ করে নিয়োগ জটিলতা নিরসনে স্থায়ী সমাধান করতে হবে।