'স্বল্পোন্নত দেশ যখন উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে হাটছিল ঠিক তখনই মার্চ মাসে করোনা ভাইরাস (কোভিট-১৯) এর থাবায় মাঝ পথে আটকে যায় বাংলাদেশ'। করোনায় আটকে থাকা দেশ যেন প্রাণ ফিরে পায় ১০ ডিসেম্বর, বিজয়ের মাসে চারিদিকে নতুন বিজয়ধ্বনি বাজতে থাকে, দেশ থেকে শুরু করে বিশ্ব গণমাধ্যমে ভাসতে থাকে বাংলাদেশের প্রসংশা, সবার মুখে একটা কথায় শোনা যাচ্ছিল 'ও পৃথিবী এবার এসে বাংলাদেশ নাও চিনে'। সেদিন দুপুর ১২টা ২ মিনিটে পদ্মাসেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১তম স্প্যান, সেই স্প্যান বসানোর মাধ্যমেই দৃশ্যমান হয় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বাষির্কীতেই বাস্তবে ধরা দেয় দীর্ঘদিনের এক স্বপ্ন । মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।
২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রায় সাত বছর কাজ এগোয়নি। স্থান নির্ধারণের পর অর্থায়ন জটিলতায় যায় আরও পাঁচ বছর। কথিত জটিলতায় বিশ্বব্যাংকও মুখ ফিরিয়ে নেয়, বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সেতু অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মসেতুর উপর বসেছিল প্রথম স্প্যান । দেশী বেদশী মহলের শত চক্রান্তের বাধা পেরিয়ে ঠিক পাঁচ বছর পর সবক'টি স্প্যান বসানোর মাধ্যমে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়। পদ্মাসেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন পদ্মাসেতু দিয়ে চলাচল করবে ২১ জেলা মানুষ, ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে দেশের সর্ববৃহৎ পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হবে। এখন মূল সেতুর বাস্তবায়ন কাজের অগ্রগতি ৮৪ শতাংশ।
এদিকে করোনা প্রাদুর্ভাব থাকার পরও রাজধানীতে এগিয়ে চলছে মেট্রো রেলের কাজ, যানজটের শহর ঢাকায় প্রথমবারের মতো চালু হতে যাচ্ছে মেট্রোরেল, মূল সড়ক থেকে প্রায় ১৩ মিটার উঁচুর উড়াল পথে বসছে রেললাইন, চলছে স্টেশন নির্মাণের কাজ, বিদ্যুৎ-সংযোগের জন্য খুঁটিও বসে গেছে ইতোমধ্যে। রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত উড়ালপথে মেট্রোরেলের দূরত্ব ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। প্রতিদিন ৪ লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে, সময় লাগবে ৩৫ মিনিট। মেট্রোরেল পুরোপুরি চালু হওয়ার কথা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৫০ দশমিক ৪০ শতাংশ।
গত ২৭ ডিসেম্বর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে যুক্ত হয় নতুন ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ ‘ধ্রুবতারা’, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজের নাম রাখা 'দ্রুবতারা' বিমানটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। এর আগে ২৪ নভেম্বর দেশে আসে বিমানটি। এ উড়োজাহাজ যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বিমান বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা এখন ১৯। বিমান বাংলাদেশ জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ও কানাডা সরকারের মধ্যে জি-টু-জি ভিত্তিতে ক্রয় করা তিনটি উড়োজাহাজের মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ দুটি যথাক্রমে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি ২০২১-এ বিমান বহরে যুক্ত হবে। নতুন উড়োজাহাজ বহরে সংযোজনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও স্বল্প দূরত্বের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গন্তব্যগুলোয় বিমান-এর সাপ্তাহিক ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি করা হবে। কানাডার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডি হ্যাভিল্যান্ড নির্মিত, ৭৪টি আসন বিশিষ্ট ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজটি পরিবেশবান্ধব এবং অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ। উড়োজাহাজটিতে এইচইপিএ (হাই-ইফিসেন্সি পার্টিকুলেট এয়ার) ফিল্টার প্রযুক্তি রয়েছে। যা মাত্র ৪ মিনিটেই ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসসহ অন্যান্য জীবাণু ধ্বংসের মাধ্যমে উড়োজাহাজের অভ্যন্তরের বাতাসকে করে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ করবে ‘ধ্রুবতারা’।
হাটি-হাটি পা-পা করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে এখন বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে মাথা পিছু আয় ছিল ১ হাজার ৯০৯ ডলার, করোনার প্রাদুর্ভাব থাকার পরও ২০২০ সালে মাথা পিছু আয় দাড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার । মানব উন্নয়ন সূচকেও গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ, সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৩৩। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০২০ সালের দ্য হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পঞ্চম অবস্থানে আছে। তবে পরিবেশের প্রভাবজনিত সমন্বিত মানব উন্নয়ন সূচক অনুযায়ী আরও ৯ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। করোনার সংকট কাটিয়ে এবছরের রেমিট্যান্স আয় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ, এছাড়া বিজয়ের মাসে রির্জাভ দাড়িয়েছে ৪২ বিলিয়র ডলার ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জনতার হাতে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে এসেছে বলেই, দেশের উন্নয়নের গতি সচল হয়েছে। ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ-এনইসি বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। বৈঠকে 'অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চুড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদের পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে অর্থমূল্য ধরা হয়েছে, ৬৪ হাজার ৯ শ ৫৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন টাকা। এই পা'চ বছরে দেশে প্রায় এক কোটি সাড়ে ১৩ লক্ষ লোকের চাকরীর সুযোগ তৈরি হবে। ৫৪টি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ ২৫টি গবেষণা পত্র ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে উন্মুক্ত আলোচনা করে পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানান সংবাদ সম্মেলনে।
নোয়াখালীর হাতিয়া থানাধীন চর ঈশ্বর ইউনিয়নের অধীন ১৩ হাজার একর আয়তনের দ্বীপে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে স্থানান্তরের জন্য ভাসান চরকে সাজিয়ে তুলতে খরচ হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার দৃষ্টান্তস্থপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এরপর উন্নত জীবনযাপনের জন্য সবুজেঘেরা দ্বীপের মাঝে লাল রঙের ছাউনি দিয়ে নির্মাণ করা হয় বহুতল ভবন, এখানে এক লাখ রোহিঙ্গাকে থাকা, রান্নার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি আর ময়লা নিষ্কাশন, শিশুদের খেলার মাঠ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহের সুযোগও সেখানে তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ ডিসেম্বর প্রথম দফায় নারী-পুরুষ-শিশু মিলিয়ে প্রথমবার মোট এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। দ্বিতীয় দফায় হস্থান্তর করা হয়েছে ১ হাজার ৭০০ বেশি রোহিঙ্গাকে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের বুকে মানবতার এক অনন্য স্থাপন করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
করোনার প্রকোপে যখন উন্নত রাষ্ট্রগুলো নিজেদর এগিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে তখন উন্নয়নশীল দেশের পথে হাটছে বাংলাদেশ, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ করতে পাঁচটি দেশকে বাছাই তালিকায় রেখেছে সিডিপি। ২০২১ বছরের ২২-২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ত্রিবার্ষিক সভায় বিষয়টি মূল্যায়ন করবে সিডিপি, ওই তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে, অপর চারটি দেশ হল নেপাল, মিয়ানমার, লাওস ও তিমুর লেসেথো।
বিশ্বে প্রায় ১৮০টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী করোনা, বিশ্বের সব দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশও বিপর্যস্ত হয় অর্থনীতিতে। করোনাক্রান্তিকালে সরকারি ছুটি ঘোষণার পর কর্মহীন হয়ে পড়ে অসংখ্য মানুষ, খবর আসতে থাকে দেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। হয়ত তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনে কড়া নাড়ছিল ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই কথাটি : এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পাবে, পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন; তখনই শুধু এই লাখো শহীদের আত্মা তৃপ্তি পাবে’। ১৪মে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ২৫০০ টাকা করে করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া ৫০ লাখ পরিবারের কাছে আর্থিক সহায়তা বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঈদ উপহার হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পৌছেঁ যায় এই অর্থিক সহায়তা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত 'জমি আছে ঘর নাই প্রকল্পে' সাড়ে ৮ লাখ ৫৫ হাজার পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে, যেটার কাজ চলমান রয়েছে বলে ভোরের পাতাকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ এর প্রকল্প প্রকৌশলী (নিবার্হী প্রকৌশলী) আবুল কালাম আজাদ।