বিদায় শব্দটার সাথে যতোটা বেদনা মিশে আছে, ২০২০ সালকে বিদায় জানাতে মন ততোটা ভারাক্রান্ত হবে বলে মনে হয় না। যেন ২০২০ কে বিদায় জানাতে পারলেই মুক্তি কারন এ বছরের পুরোটাই দখলে ছিল কোভিড-১৯ নামে ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের। নোভেল করোনা ভাইরাস পুরোটা বছর জুড়েই নাকানি চুবানি খায়িয়েছে গোটা বিশ্বকে। আধুনিক বিশ্বসভ্যতাকে দাঁড় করিয়েছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। হঠাৎ অচেনা এক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর অসহায়ত্ব দেখেছে মানুষ। পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠী, প্রায় ৪০০ কোটি মানুষকে মাসের পর মাস ঘরবন্দি থাকতে বাধ্য করেছে এই মহামারি। একপ্রকার থমকে গেছে পুরো বিশ্ব। এ বছর গোটা দুনিয়া ওলটপালট করে দেওয়ার বছর।
২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের মাধ্যমে সারা দেশ আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ে। ১৮ মার্চ করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যুতে দেশের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে লকডাউনে চলে যায় পুরো দেশ। বছর জুড়েই ছিল জনমানসে মহামারি আতঙ্ক। এ বছরের সব আলোচিত ঘটনাই করোনাভাইরাসকে ঘিরেই তবে এর বাইরেও নানা সময়ের নানা ঘটনা আলোচনায় এসেছে। আছে অনেক অর্জন ঠিক তেমনি বাংলাদেশ হারিয়েছে তার অনেক রত্নকে।
২০২০ সালে বাংলাদেশের অন্যতম বড় অর্জন দৃশ্যমান পদ্মা সেতু। দৈর্ঘ্যের দিক থেকে বিশ্বের ১১তম সেতু পদ্মা সেতু। গত ১০ ডিসেম্বর পদ্মা নদীতে দৃশ্যমান হয় পদ্মাসেতুর ৬.১৫ কিলোমিটার। স্বপ্নের এই পদ্মাসেতু নির্মাণে দেশি-বিদেশী নানান ষড়যন্ত্র হয়েছে। নির্মাণের শুরুতেই আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জর মুখে পড়ে। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মাসেতুর অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর পদ্মাসেতুকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা এবং তিনি ঘোষণা করেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে। নিজেদের টাকায় শুরু হয় পদ্মাসেতু বাস্তবায়নের কাজ এবং শেখ হাসিনার এই সাহসী উদ্যোগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রসংশিত হয়।
করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে টালমাটাল সেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পরাটাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সোয়া লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রবাসীদের রেমিটেন্স সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে রেমিটেন্স বাবদে দেশে এসেছে ২১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালের পুরো সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। এর উপর ভর করে ৪৩বিলিয়ন ডলারের (৪হাজার৩০০কোটি টাকা) মাইলফলকেছুঁতেচলেছে। অতিক্রম করেছে রিজার্ভ। বাংলাদেশের রিজার্ভ এখনপাকিস্তানের দ্বিগুণেরও বেশি। দেশের রপ্তানি আয় ইতিবাচক এবং মূল্যস্ফীতি সহনীয়।
মানব উন্নয়ন সূচকে গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৩৩ এবং দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের আছে পঞ্চম অবস্থানে।
২০২০ এর অন্যতম এক অর্জন হচ্ছে অনুর্ধ্ব ১৯ যুব ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা অর্জন। বাংলাদেশ প্রথম কোন বড় আসরে এটাই সর্বোচ্চ অর্জন।
করোনা পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধের মাঝেও জীবন একদম থেমে থাকেনি। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে কর্মজীবন, বানিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা চলছে বছরজুড়ে। প্রযুক্তির ব্যবহারে এক বছরে কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে। ঘরে বসে অনলাইন মিটিং, অনলাইন ক্লাস, অনলাইনে অফিস এমনকি অনলাইনে কেনাকাটা করেছে মানুষ।
২০২০ জুড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করেছে বিভিন্ন কুচক্রীমহল। পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে, নিখোঁজ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, লবনের দাম বৃদ্ধি, মোটরযান আইন, ভুয়া নোট ইত্যাদি নানান গুজব ছড়িয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ফায়দা নেবার চেষ্টা করেছে।
ভাস্কর্য ইসলামে বৈধ নাকি অবৈধ? মুসলিম প্রধান দেশে ভাস্কর্য থাকা উচিত নাকি উচিত না? ভাস্কর এবং মূর্তি কি আলাদা নাকি একই? বছরের শেষ অংশে এই ইস্যুতে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গন সরগরম ছিল। যে পিতা বাংলাদেশ নামক এক ভূখণ্ডের জন্ম দিয়েছেন, তার ভাস্কর ভেঙে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে দুর্বৃত্তরা। কতিপয় ইসলামী বক্তা ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়ার হুমকির পর গত ৪ ডিসেম্বর রাতে কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। ঢাকার ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্যকে ‘মূর্তি’ আখ্যা দিয়ে তা অপসারণের দাবি করছে কিছু ইসলামিক গোষ্ঠী৷ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ভাস্কর্যবিরোধী তথাকথিত মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারির পর আপাতদৃষ্টিতে তাদের নমনীয় মনে হচ্ছে। তবে এটা অনুমেয় যে এই তথাকথিত মৌলবাদকে আস্কারা দিলে সরকারের গলার কাঁটা হয়ে গেঁথে থাকবে এরা।
২০২০ সালের অনেকটা সময় জুড়েই ছিল ধর্ষণ ইস্যু। ধর্ষণের ঘটনা ও ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় আন্দোলনের মাঠ ছিল সরগরম। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দেশিব্যাপী লাগাতার আন্দোলন করেছে শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও নারী অধিকার কর্মীরা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপাত্ত অনুযায়ী ২০১৭-২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯-২০২০ সালে দেশে ধর্ষণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বাদ যায়নি প্রতিবন্ধী কিংবা ছয় বছরের শিশুও৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে এসব নারী ও শিশুকে৷ মানবাধিকারকর্মীদের মতে, বাংলাদেশে ধর্ষণ বাড়ার অন্যতম কারণ হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। প্রতিবছর যে পরিমাণ ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সে তুলনায় বিচারের হার অত্যন্ত কম। নারী ও শিশু ধর্ষণের ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার মাত্র ২.৬ শতাংশ চুড়ান্ত বিচারের রায় হয়। দলীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আইনের ফাঁকফোকরে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় অনেক ধর্ষক।
এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী, সরকারি আমলা আর রাজনীতিবিদদের লাগামহীন দুর্নীতি এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে পেছন থেকে টেনে ধরে। শাহেদের মতো দুর্নীতিবাজেরা প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে কোটপতি বনে যায়। প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার চারটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) কাছ থেকে কমপক্ষে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কানাডার বেগম পাড়ায় গড়েছে সম্পদের পাহাড়। তার মতো অনেক বাংলাদেশি ‘বেগম পাড়ায়’ বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। এর জন্য তারা ব্যয় করছেন বাংলাদেশ থেকে পাচার করা কোটি কোটি টাকা। তবে আশার কথা হচ্ছে কানাডার টরন্টোর ‘বেগম পাড়া’য় যাদের বাড়ির মালিকানা রয়েছে, এমন সরকারি কর্মকর্তাদের তালিকা দেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এমন কয়েক শত বা হাজার হাজার শাহেদ, পিকে হালদার, পিকলুরা সরকারের উন্নয়ন অভিযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। এদের কঠোর হস্তে দমন করা সময়ের দাবি।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কোন এক বছরে এতো সূর্যসন্তানকে হারাতে হয়নি, যতোটা না এ বছরে হারিয়েছি। সারা পৃথিবীতেই বিষাদের বছর হিসেবে ইতিহাসে থেকে যাবে ২০২০ সাল, ঠিক তেমনি বাংলাদেশেও শোকের পর শোক নেমেছে করোনার কারণে।
সারা বিশ্বের মতো আমরা সবাইও ২০২০ সালকে বিদায় দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। জীবন ও জীবিকার ওপর আঘাতের যে চিত্র বছরজুড়ে মানুষ দেখেছে, গত ১০০ বছরেও তা দেখা যায়নি। মহামারীর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা নিয়েই নতুন বছরে পা দিয়েছি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কতোটা প্রভাব ফেলবে সেটাও আমাদের অজানা। অজানা এক উদ্বেগকে সঙ্গী করে ২০২১ সালে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি হিসেব না কষে সামনে এগিয়ে যাবো সে প্রত্যাশাই করি।
লেখক: নুমান মাহফুজ, শিক্ষক, লোক প্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। মশিউর রহমান, অনলাইন এক্টিভিস্ট ও তরুণ উদ্যোক্তা।