প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১:৫১ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় গণহত্যা চালায় পাক হানাদার বাহিনী। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারেও ব্যাপক গণহত্যা চালায় হানাদাররা। মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার একটি হিন্দুপ্রধান গ্রাম ছিল পাঁচগাঁও। এই নিভৃত পল্লিতেও মুক্তিযুদ্ধের তিন মাসের মাথায় ব্যাপক গণহত্যা চালায় নরপশুরা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে হিন্দুপ্রধান পাঁচগাঁও গ্রামে দুই শতাধিক লোককে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। কেবল ৭ মে তারিখেই হত্যা করা হয় একশতাধিক লোককে। পাঁচগাঁও গণহত্যার এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর রাজাকাররা ডাকাত বেশে স্থানীয় রমণ চন্দ্র ঘোষের বাড়িতে আক্রমণ করে। একই রাতে ডাকাতি করে রমেশ চন্দ্র ঘোষ ও দক্ষিণ পাঁচগাঁওয়ের সুখেশ চন্দ্র দেবের বাড়িতে। কয়েক লাখ টাকার মালামাল ডাকাতি করে নিয়ে যায় তারা। গ্রামবাসীরা জানান, গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার আলাউদ্দিন চৌধুরী ও হারিছ উল্লাহ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য পাকিস্তানি বাহিনীকে গ্রামে নিয়ে এসেছিল।
গণহত্যার আগের দিন অর্থাৎ ৬ মে থেকে পাঁচগাও গ্রামের অবস্থা গুমোট হয়ে পড়ে। আলাউদ্দিন ও হারিছ রাজাকারের চালচলনে একরকম রহস্য দেখা যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। কিন্তু গ্রামবাসী কল্পনাও করতে পারেনি আলাউদ্দিন ও হারিছ প্রমুখ রাজাকারেরা এতো নির্মম হতে পারে। ডাকাতির ভয়ে গ্রামে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয় রাজাকাররা ৭ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গ্রামে নিয়ে আসে। সেদিন রাতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। গ্রামের নিরীহ জনসাধারণ সারাদিন কাউয়াদিঘী হাওরে বোরো ধান কাটা শেষে যখন রাতের বেলা গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল ঠিক তখনই ভোর রাতে রাজাকার আলাউদ্দিন চৌধুরী, ডা. আনমিয়া, আব্বাস মেম্বার, আব্দুল মতিন প্রমুখ ৫০-৬০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে পাচগাঁও গ্রাম ঘিরে ফেলে।
রাজাকাররা গ্রামবাসীদের বলে, তোমাদের কোন সমস্যা হবে না। পাকিস্তানি জিন্দাবাদ বলো। শান্তির মিটিং করেই তোমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। এরপরেই গ্রামে শুরু হয় লুটপাট। মহিলা ও শিশুদের ঘর থেকে বের করে ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা। আকাশ তখনো হালকা অন্ধকারে ঢাকা আচ্ছন্ন। গ্রামবাসীকে পশ্চিম দিকে মুখ করে দিঘীর পাড়ে বসতে বলে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে। আত্তর ম-ল ও মদরিছ মিয়া প্রমুখ রাজাকাররা সমবেত গ্রামবাসীকে একজনের মাথা অন্যজনের পায়ের সাথে বেঁধে জোড়া জোড়া করে দিঘীর পানিতে একে একে লাথি মেরে ফেলে দেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঁধা অবস্থায় পানিতে ফেলে দেওয়া মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করা মানুষগুলোকে ঠা-ামাথায় গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। মানুষগুলোর মৃত্যু নিশ্চিত হলে পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে যায়। দিঘীর জলে কুচুরিপানার মত ভেসে ওঠে মানুষের লাশ আর লাশ। এই পৈশাচিক হত্যাকা-ের শিকার গ্রামবাসীর সকলের নাম পাওয়া না গেলেও ৬৯ জনের নাম পাওয়া যায়। নিহতদের মধ্যে নিত্য রাণী শব্দকর নামে একজন মহিলাও ছিলেন।
দৈবক্রমে নারকীয় ঘটনার মধ্যে থেকে বেঁচে যান কয়েকজন। তারা হলেন- সাধু শব্দকর, কটি শুক্লবৈদ্য, চরিত্র শব্দকর, সুখময় শব্দকর, নারায়ণ মালাকার প্রমুখ। এদের কারো নাকে, কানে, কারো হাতে বা পায়ে গুলি লেগেছিল। নিরীহ গ্রামবাসীর রক্তে সেদিন দিঘীর পানি লাল হয়ে গিয়েছিল। নিহতদের মৃতদেহ সারাদিন সেখানে পড়ে থাকে। পরদিন গ্রামের কিছু লোক পুকুরে জাল ফেলে লাশ তুলে দিঘীর পশ্চিম পাড়ে সমাহিত করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে নিহতদের লাশগুলো আত্মীয়-স্বজনরা দাহ করতেও পারেনি।
মৌলভীবাজার জেলার গণহত্যা জরিপ করেছেন ইতিহাস গবেষক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তপন পালিত। তার জরিপের পর অসংখ্য নতুন গণহত্যার কথা আমরা জানতে পেরেছি। সর্বশেষ গণহত্যা জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে গোটা বাংলাদেশে ছয় হাজারের ওপর গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত এক মাসে আমরা সেই ছয় হাজার গণহত্যা থেকে মাত্র ৩১টি গণহত্যার ঘটনা জানতে পারলাম। এই সিরিজে আমি চেষ্টা করেছি মোটামুটি কম আলোচিত গণহত্যার ঘটনাগুলো তুলে আনতে। আমার এই সিরিজ পড়ার পর কেউ যদি নিজের এলাকার গণহত্যার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে নূন্যতম আগ্রহী হয়ে ওঠে তাহলেই আমার পরিশ্রমকে সফল বলে মনে করবো।