আজ
কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে আরও একটি বছর। আজকের অস্তগামী সূর্যের কাছে
প্রশ্ন রেখেও মিলবে না অনেক উত্তর। কি পেয়েছে, কি হারিয়েছে দেশ তার হিসাব
ঠিকই মিলাতে বসছে মানুষ। কারণ একটি বছর মানেই জীবনের একটি অধ্যায়; কালের
একটি খণ্ড। আর সে খণ্ডের পরতে পরতে সাফল্য-ব্যর্থতার যে ছাপ পৃথিবী রেখে গেছে
তার সুতা ধরেই মানুষ এগিয়ে যেতে চাইবে সামনে। ২০২০-কে কেউ বলছেন বিশে
বিষময়। কেউ বলছেন অভিশপ্ত এক সন। করোনা মহামারির কারণে গোটা বিশ্বকে মূলত
নতুন এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
বিষাদ আর বিধ্বস্ততায় আচ্ছাদিত এ
বছরটি যে কোনোভাবেই ভুলতে চায় মানুষ। এ বিপন্নতায় ভরা বছরটিকে ভুলবার মতো
অনেক অনুসঙ্গই হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু যে ছায়া এদেশের মানুষ গত এক বছরে,
বিশেষ করে মহামারিতে হারিয়েছে, সে ছায়া কি আর কখনো মিলবে? অধ্যাপক জামিলুর
রেজা চৌধুরী, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, সাংবাদিক কামাল লোহানী, চিত্রশিল্পী
মুর্তজা বশীর, অভিনেতা আলী যাকের, সুরকার আলাউদ্দীন আলী, সঙ্গীতশিল্পী
এন্ড্রু কিশোর, নাট্যকার মান্নান হীরা, সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত, লেখক
রশীদ হায়দার, অভিনেতা আবদুল কাদের, অভিনেতা মহিউদ্দিন বাহার, ভাস্কর মৃণাল
হক, মঞ্চাভিনেত্রী ইশরাত নিশাত, সুরকার সেলিম আশরাফ, চলচ্চিত্র পরিচালক
মহিউদ্দিন ফারুক, অভিনেত্রী ফেরদৌসি আহমেদ লীনা, সুরকার আজাদ রহমানের মতো
কীর্তিমান সন্তানদের হারিয়ে কেঁদেছে দেশ। এত সম্পদ হারিয়েও আশায় বুক বেঁধে
নতুন দিনের যাত্রা মানুষকে ঠিকই করতে হচ্ছে। পুরানো বছরের জীর্ণতা, ক্লেদ,
দুঃখ-বিষাদ, ব্যর্থতার সব গ্লানীকে মুছে দিতে কি পারবে নতুন বছর? এ পর্বতসম
প্রত্যাশার উঠানেই আগামীকাল বিচ্ছুরিত হবে নতুন সূর্যের রোদ। আর শীতের
সকালে সে সূর্যের রোদ্দুরে ওম নিতে নিতে ২০২০ বারবার হানা দেবে স্মৃতিতে।
২০২০-এ
কি কেবল বিষ আর বিষাদই জুটেছে আমাদের। আনন্দ-আহ্লাদ, হর্ষধ্বনি জাগানিয়া
কিছুই কি জুটেনি জাতীয় জীবনে? একটা পদ্মা সেতু যখন তার পূর্ণ অবয়ব নিয়ে
পদ্মার বুকে শাণিত গৌরব ঘোষণা করলো সেদিন কি সব গ্লাণী-ক্লেদ মুছে যায়নি
মানুষের মন থেকে? নিশ্চয় গেছে। কত ষড়যন্ত্র, কত বাধা-বিপত্তি তুড়ি মেরে
উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের অর্থায়নে এ দেশ বহুল আকাক্সক্ষার পদ্মা সেতু নির্মাণে
হাত দিয়েছিল, গত ১০ ডিসেম্বর সর্বশেষ স্প্যান স্থাপনের মধ্য দিয়ে সে পদ্মা
সেতু তার পূর্ণ অবয়ব পেল। আর তাতেই যেন গোটা বছরের বিষাদ ঢাকা পড়ে গেল
নিমিষে। কারণ, এ তো গর্বের স্মারক, জাতীয় সক্ষমতা এবং সাফল্যের প্রতীক। ফলে
এ ঘটনাই এনে দিয়েছিল গত এক বছরের সব থেকে বড় আনন্দঘন মুহূর্ত।
চলমান
মুজিববর্ষে ২০২০ আরও আনন্দপূর্ণ মুহূর্ত দেশকে উপহার দিতে পারতো- যদি সব
উৎসব-উদযাপন উন্মুক্ত পরিসরে, মানুষের বিপুল সমাবেশের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন
হতো। কিন্তু মহামারি সেখানে আটকে দিয়েছে সব। অথচ স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির
জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে তার
প্রস্তুতি বছরের শুরুতেই জাঁকজমকভাবে শুরু হয়েছিল। মুজিব শতবর্ষের
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথা ছিল বিভিন্ন দেশেরও। মহামারির কারণে সেটা আর
ঘটেনি। অথচ মুজিববর্ষ আমাদের জন্য শত শত চমক নিয়ে হাজির হয়েছিল। এখনো নানা
চমক বাকি রয়ে গেছে। আসন্ন বছরে পূর্ণ হচ্ছে মুজিব শতবর্ষ। আর শুরু হচ্ছে
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। সালতামামিতে চোখ বুলালে যে কয়টি ঘটনা গোটা বছরে
আলোচনায় ছিল সে ঘটনাগুলো নানাভাবে অভিঘাত ফেলে গেছে জাতীয় জীবনে। করোনায়
নতুন অভিজ্ঞতা, স্বাস্থ্যখাতে অস্থিরতা, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও কীর্তিমান
ব্যক্তিদের প্রয়াণ, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে
উত্তাপ সৃষ্টির চেষ্টার ঘটনা নানামাত্রিক অভিঘাত তৈরি করেছে মানুষের মাঝে।