ড. কাজী এরতেজা হাসান
দ্বিতীয় দফায় গত মঙ্গলবার ১ হাজার ৮০৪ জন রোহিঙ্গা ভাসানচরে গিয়ে পৌঁছেছে। দুই ধাপে ৩৪৪৬ রোহিঙ্গার ঠাঁই হলো এখানকার আশ্রয়নে। মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত অন্তত এক লাখ নাগরিককে এভাবে ক্রমান্বয়ে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে পাঠানো হবে। আশা করা যায় এতে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের পরিবেশের কিছুটা উন্নতি হবে। অন্যদিকে ভাসানচরে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের তুলনায় স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারবেন। মূলত প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন আবাসস্থল হিসেবে রোহিঙ্গাদের এখানে স্থানান্তর করা হচ্ছে। মূল কাজ যেটি, সেটি হলোÑ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। মিয়ানমারের এইসব নাগরিকদেরকে যতদ্রুত সম্ভব মিয়ানমারের প্রত্যাবাসন করতে হবে। এ ব্যাপারে মিয়ানমার সরকার আর যাতে টালবাহানা এবং কোনো ধরনের অজুহাত দাঁড় করাতে না পারে, তার দিকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নজর দিতে হবে। অত্যাচারী মিয়ানমার সরকার ও তাদের সেনাবাহিনী নিজ দেশের নাগরিক রোহিঙ্গাদের নিধন অভিযান চালিয়েছে। হত্যা-নির্যাতন-ধর্ষণসহ নানা নিপীড়নের মধ্য দিয়ে সভ্যতার ভয়াবহতম ‘এথনিক ক্লিনজিং’ চালানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর। এ ভয়াবহতার হাত থেকে বাঁচতে প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা দলে দলে স্রোতের মতো পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। এ আগে থেকে এদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত ছিল আরো ২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
এদের ভরণপোষণ করতে গিয়ে আমাদের সরকারের পেরেশানি বেড়ে গেছে। বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এসব রোহিঙ্গাকে যেভাবে নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছেন গোটা বিশ্বে তা বিরল। এখন বাংলাদেশের সামনে মোটাদাগে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে এসব রোহিঙ্গাকে কবে নাগাদ মিয়ানমার সরকার ফিরিয়ে নেবে? জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য বার বার চাপ দিয়ে আসলেও প্রত্যাবাসনের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। তবে বড়ই দুঃখজনক ঘটনা হলো, মিয়ানমার সরকারের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রোহিঙ্গারা যখন দলে দলে নাফনদী পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে, তখন সরকার ঢুকতে বাধা দেয়। কিন্তু তখন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শেখ হাসিনা সরকারের এ পদক্ষেপকে নিন্দা জানান। রোহিঙ্গারা মুসলমান- এ ধুয়া তুলে তাদের দেশে ঢুকতে সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু বিএনপি নেত্রী (বর্তমানে সাজপ্রাপ্ত) এটা চিন্তা করেননি যে এই রোহিঙ্গারা একবার দেশে ঢুকে পড়লে আদৌ তাদেরকে মিয়ানমার ফিরিয়ে নেবে কি-না, তা বলা যায় না। এর ফলে রোহিঙ্গাদের কারণে দেশের ওপর যে ভয়ানক চাপ পড়বে তার প্রভাব কাটানো কঠিন হবে। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের কারণে পরিবেশের যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার খবর এখন নিশ্চয় বিএনপির নেতারা জানেন।
বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এতটা বিচক্ষণ যে তিনি উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের পাশাপাশি, তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এ ব্যাপারে তিনি হাল চেড়ে দেওয়ার মানুষ নন। আমরাও মনে করি মিয়ানমার সরকার বাধ্য হবে তার নাগরিকদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে। মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে চীন এতদিন নমনীয় ছিল না। চীন বর্তমানে নমনীয় হয়েছে, তারাও বাংলাদেশের স্বার্থকে উচ্চে রাখার পক্ষপাতি। চীন যদি শুধু মিয়ানমারের মনোভাব মতো চলে তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কখনোই গভীর স্থানে পৌঁছাতে পারবে না।
প্রথম দফায় রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানোর ব্যাপারে নানা মহল সমালোচনায় মেতে ওঠে। এমনকি জাতিসংঘসহ নানা আন্তর্জাতিক মহল থেকে অসহযোগিতাই লক্ষ করা গেছে। বলা হয়েছিল রোহিঙ্গাদের অমতে, অনেকটা জোর করেই তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভাসানচর তাদের জন্য অনিরাপদ। কিন্তু প্রথম দফায় রোহিঙ্গারা সেখানে গিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছে যে ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর, ঘিঞ্জি, অনিরাপদ ও বদ্ধ পরিবেশের চেয়ে ভাসানচরের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তাসহ অভূতপূর্ব আশ্রয়ন কাঠামো তাদের জন্য সব থেকে উপযোগ্য। প্রথম দফায় স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারাই তাদের স্বজনদের প্রলুব্ধ করেছে ভাসানচরে যেতে। দ্বিতীয় দফায় যারা গেছে তারাও প্রচ- খুশি- এমন দারুণ আশ্রয়নের স্থান পেয়ে। দ্বিতীয় দফায় রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যাওয়ার ঘটনা মূলত নানা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রেরই উপযুক্ত জবাব। ভাসানচর নিয়ে বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর অপপ্রচার আর কাজে আসছে না। চার সপ্তাহ আগে প্রথম ধাপে দেড় সহস্রাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে যখন নোয়াখালীর ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তাদের চোখে-মুখে ছিল দুশ্চিন্তার ছাপ। অচেনা দ্বীপাঞ্চলে কেমন পরিবেশে থাকতে হবে তা নিয়ে তাদের মধ্যে ছিল জল্পনা-কল্পনা। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে ভাসানচরের পথে যাত্রা করা রোহিঙ্গা সদস্যরা যাচ্ছেন হাসিমুখে। এতদিন যে পরিবেশে ছিল তার চেয়ে উন্নত পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেখানে যাচ্ছে তারা।
জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচর নেওয়ার আগে পালস বাংলাদেশ সোসাইটি, কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ, ফ্রেন্ডশিপ, এসএডব্লিউবি, শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, গ্লোবাল উন্নয়ন সংস্থা, আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার, সনি ইন্টারন্যাশনাল, আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন, হেলথ দ্য নিডি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, জনসভা কেন্দ্র, কারিতাস বাংলাদেশ, সমাজকল্যাণ উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস), সোশ্যাল এইড, সিডিডি, মুক্তি-কক্সবাজার, ভলান্টারি অরগানাইজেশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, আরটিএম ইন্টারন্যাশনাল, মাল্টি সার্ভ ইন্টারন্যাশনাল, আল্লামা ফয়জুল্লাহ ফাউন্ডেশন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ফর অল নামে ২২টি এনজিওর প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে সরকারের পরিকল্পিত আয়োজনে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ইতিমধ্যে এসব এনজিও সেখানে কাজও শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ আরও অনেক এনজিও। নোয়াখালীর হাতিয়ায় সাগরের মাঝে ভেসে থাকা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য সবধরনের সুযোগ-সুবিধাসংবলিত ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে সেখানে। বসবাসের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তা দেখতে গত সেপ্টেম্বরে দুই নারীসহ ৪০ রোহিঙ্গা নেতাকে সেখানে নিয়ে যায় সরকার। তারা ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হয়। তারা ক্যাম্পে ফিরে অন্যদের সেখানে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। উল্লেখ্য, দুই বছর আগে সরকার ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তাদের অনিচ্ছার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে এর যাত্রা শুরু হওয়ায় উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করছেন।
ভাসানচরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের অনেকে জানান, তারা ভাসানচর পরিদর্শন শেষে ফিরে আসা রোহিঙ্গা নেতাদের মুখে সেখানকার বর্ণনা শুনে এবং প্রথম ধাপে যাওয়া রোহিঙ্গাদের অভিজ্ঞতা জানার পর সেখানে যেতে রাজি হয়েছে। তাদের মতে, পাহাড়ের ঘিঞ্জি বস্তিতে বসবাসের চেয়ে ভাসানচর অনেক নিরাপদ হবে। এছাড়া সেখানে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য নির্মিত অবকাঠামো অনেক বেশি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে বলে মনে করছে তারা। কোনো বলপ্রয়োগ ছাড়াই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যাওয়ার ইতিবাচক মনোভাব দেখে তাদের সেখানে পাঠানোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় সরকার। রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে নিরাপদে ভাসানচরে পাঠাতে পারায় আরও অনেক পরিবার সেখানে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে বলে গতকালের দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। পরিশেষে বলা জরুরি যে, বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রোহিঙ্গাদের প্রতি যে বদান্যতা দেখাচ্ছেন, তা মানবতার প্রর্দশনের ইতিহাসেও বিরল। বিশ্বজুড়ে যেখানে মানবতা বারবার মার খাচ্ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে, সেই সময়েই গণতন্ত্রের মানসকন্যা-স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতার রক্ষার এক মূর্তপ্রতীক। তবে বিশ্ব সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকট মোচনে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়াতে হবে; তাহলেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কাজ তাড়াতাড়ি সম্ভবপর হবে।