প্রকাশ: বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:২২ পিএম আপডেট: ৩০.১২.২০২০ ২:২৮ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
সারাবিশ্বে করোনা মহামারির ভয়াবহতায় শরণার্থীদের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবী ও মানবাধিকার কর্মীরা। কারণ শরণার্থী শিবিরগুলোর সংকীর্ণ পরিসরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অনেকটা দূরূহ। শরণার্থী শিবিরগুলোর জন্য পর্যাপ্ত স্যানিটাইজার ও মাস্কের ব্যবস্থা করার সম্ভবনা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। শরণার্থীদের মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়লে দেশেগুলোর সরকার তাদেরকে সমাজ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করা, চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতার বিষয়ক শঙ্কাও ছিল পাশাপাশি। ভাল খবর হল করোনায় আক্রান্ত হয়ে শরণার্থী মৃত্যুর ঘটনা কিন্তু কমই ঘটেছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে করোনা মহামারি যতটা অনুমান করা হয়েছিল ছড়ায়নি ততটা। এরপরও শরণার্থীদের জন্য ২০২০ ছিল দুঃস্বপ্নের মত। করোনাভাইরাস থেকে শারীরিকভাবে তারা বাঁচতে পেরেছেন ঠিকই, কিন্তু এটাকে তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে বিভিন্ন দেশ।বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বছরজুড়ে বিভিন্ন দেশে তিন হাজার দুইশোর বেশি শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই সাগরপথে অন্য দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছেন। এ বছর স্প্যানিস ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ থেকে সুদান পর্যন্ত নতুন করে শরণার্থী সঙ্কট শুরু হয়েছে। বহু শরণার্থীকে বঙ্গোপসাগর এবং ভূমধ্যসাগরে কয়েক মাস ধরে ভেসে থাকতে হয়েছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিয়ে। করোনার ঝুঁকির জন্যে গ্রহণ করা হয়নি তাদেরকে। সেপ্টেম্বরে গ্রিসের শরণার্থী শিবির মরিয়ায় বড় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছ। ওই শিবিরটিতে ১৩ হাজার শরণার্থীর বসবাস। সেখানকার অবস্থাও অত্যন্ত মানবেতর। এদিকে গত অক্টোবরে সেনেগাল উপকূলে মৃত্যু হয়েছে ১৪০ জন শরণার্থীর। করোনা মহামারীতে ঢাকা পড়ে গেছে সমস্ত খবরই। মানবাধিকার কর্মী ও শরণার্থীদের সেই সময়ের অভিজ্ঞতার বিষয়ে দিয়ানা সাবেক শরণার্থী ও ফটোগ্রাফার জয়নাব আলহিনদাওয়ী জানান, চলতি মাসের শুরুর দিকে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে ফিরে আসেন। গত মার্চ থেকে কঙ্গোতে জাতিগত সহিংসতা চলছে। শুধু ইতুরিতেই গৃহহীন হয়েছে ১৬ লাখ মানুষ। করোনার প্রকোপের মধ্যে মানুষ এ ব্যাপারে অল্পই জেনেছেন অথবা কিছুই জানেননি। পুরো বিশ্ব এই ঘটনায় অনেকটাই উদাসীন। এই অসহায় মানুষগুলোকে নিয়ে তাদের মাথা ব্যথাই নেই। জয়নাব আলহিনদাওয়ীর নিজের দেশে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পাওয়ার বিষয়টিকে ক্রমশ করে তুলেছেন কঠিনতর। এ বছর ট্রাম্প প্রশাসনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার শরণার্থীদের আশ্রয় না দেওয়াকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য করোনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। ১৯৮৭ সালে রোমানিয়া থেকে পালিয়ে এসেছিলেন জয়নাব। তার বাবার জন্মভূমি ইরাকেও ফিরতে পারেননি। সেখানে তখন চলছিল সাদ্দাম হুসেনের শাসন। সে সময় তার বাবার পরিবার শিকার হয়েছিল ইরাকী সরকারের নির্যাতনের। যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পাওয়ার কারণে তারা তাদের ভাগ্য বদলাতে পেরেছেন। গ্রিসে আশ্রয় নেওয়া আফগান শরণার্থী আজিজ বারবারি জানান, ২০২০ সাল এখন পর্যন্ত তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ বছর। তিনি এই পুরো বছরটি মরিয়া ক্যাম্পে কাটিয়েছেন। এ বছর কোনো দিক থেকেই সেখানে কোনো সাহায্য আসছে না। অপেক্ষা করতে করতে সাহায্য পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছি তারা। রাজনীতিবিদরা কী করছে তা নিয়ে তারা মাথা ঘামান না। রাজনীতিবিদরা যা চায় তাই করে এবং অন্যরা নিঃশব্দে সেটা দেখে। আক্ষেপ নিয়ে তিনি জানান,অল্পবয়সী মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে সেখানে। আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে শিশুদের। এই শীতে শিবিরগুলোতে ঠা-ায় জমে যাওয়া মানুষ, সমুদ্রে ডুবে যাওয়া মানুষ কিংবা শুধু খাবারপ্রার্থী মানুষদের ব্যাপারে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। মোহাম্মদ আলী আলামি নামের আরও এক শরণার্থী জানান,২০২০ সাল তার জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতার বছর। তারা আহত শরীর ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে শরণার্থী হতে বাধ্য হন। তাদেরকে তাদের দেশে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এদিকে শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) পূর্ব ও হর্ন অব আফ্রিকা এবং গ্রেট লেকের আঞ্চলিক পরিচালক ক্লেমেনটাইন নেটা সালামি জানিয়েছেন, শরণার্থীদেরও ভ্যাকসিন কর্মসূচির আওতায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ২০২০ সালের শুরুতে মহামারি শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন দেশের সরকার লকডাউন, চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ এবং সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় শরণার্থীরা পড়েছেন জীবন সংকটে। কাজ হারাতে শুরু করেন শরণার্থী ও অভিবাসীরা । একই সঙ্গে বেড়ে গেছে পারিবারিক সহিংসতা, বাল্যবিয়ে, অল্প বয়সে সন্তান ধারণ এবং আত্মহত্যার ঘটনাও।