প্রকাশ: বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০, ১:৫২ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
১৯৭১ সালে যে দুর্বিষহ গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। নয় মাসব্যাপী চালানো নির্মম এই হত্যাকাণ্ডে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই দেশের প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি ইউনিয়নে, প্রতিটি গ্রামে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। আজ আমরা নাটোর জেলার একটি গণহত্যা নিয়ে আলোচনা করবো। নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার পারকোল গ্রামটি একাত্তর সালে ছিল একটি প্রত্যন্ত এলাকা। একাত্তরে সারা দেশ যেভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নিপীড়নের শিকার হয়েছিল, এই পারকোল গ্রামও একইভাবে শিকার হয়েছিল নির্মমতার।
পারকোল গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল। সেদিন ছিল রোববার। আসরের আজানের পরপরই পাকিস্তানি বাহিনী এই গ্রামে আক্রমণ করে। পারকোলের মধ্য দিয়ে নাটোরে যাওয়ার পাকা রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী অগ্রসর হচ্ছিল। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যখন গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছিল তখন গ্রামবাসী প্রাণভয়ে পালাতে থাকে নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু তারা পালিয়ে বেশি দূর যেতে পারেনি। গ্রামবাসী গ্রামের একটি পুকুরে আশ্রয় নেয়। পুকুরটি ছিল অনেক বড়। শুধু পারকোল গ্রামের নয়, পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকেও অনেক মানুষ পালিয়ে এসেছিল এখানে। সে সময়ে পুকুরে পানি কম ছিল, কিন্তু কাদা ও কচুরিপানা ছিল প্রচুর। পালানোর জন্য তারা এখানে পুকুরের পাড় দিয়ে গর্ত করে এবং তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। প্রায় ১৫০-২০০ জন মানুষ প্রাণভয়ে অনেকে কচুরিপানা, মাথাল মাথায় দিয়ে পানির মধ্যে বসে ছিল।
এমন সময় পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে প্রবেশ করে। পাক মিলিটারিরা পার্শ্ববর্তী এলাকার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পোড়া বাড়ি-ঘর ইলিম শাহ নামের একজন পুকুর থেকে উঠে গিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। এ সময় তিনি মিলিটারিদের সামনে পড়ে যান এবং দৌড়ে আবার পুকুরে নেমে যান। পাকিস্তানি বাহিনীও তার পেছন পেছন যায় এবং অতর্কিত গুলিবর্ষণ শুরু করে। মিলিটারিরা গুলিবর্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই দৌড়ে পালিয়েছিলেন। গুলিবর্ষণে শহীদ হন ২৫ জনের বেশি এবং আহত হয়েছিলেন অনেকে। অনেকের পরিচয় জানা যায়নি। তাদের মধ্যে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিল। তিনি হানাদার বাহিনীর কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন। তিনি ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি জোর হাত করনু বাবা আমার চারটি ছেলে-মেয়ে নিয়ে আপনার কাছে জীবন ভিক্ষা চাই। তখন আমাক বললি বিটি উঠাও ভাগাও।’ পাকিস্তানি বাহিনী কাউকে নিশানা করে গুলি করেনি। তারা এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। গণহত্যা চালানোর পর তারা গ্রামের একজন লোককে উল্টেপাল্টে দেখতে বলে কেউ জীবিত আছে কি না? রক্তে পুকুরের পানি লাল হয়ে যায়। অনেক দিন পর্যন্ত পুকুরের পানি কালো ছিল এবং এ পুকুরের মাছ কেউ খেত না এবং পুকুরের পানিও কোনো কাজে ব্যবহার করা হতো না। পাকিস্তানি বাহিনী এ গণহত্যা চালানোর পর বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এখানে তারা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবার বাড়ি পুড়িয়েছিল। বহু বছর সেখানে এ পোড়ার চিহ্ন ছিল। এই গণহত্যা নিয়ে বিস্তারিত মাঠপর্যায়ে গবেষণা করেন গবেষক শাপলা খাতুন। তার ‘পারকোল গণহত্যা’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র।