১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান। ছয় বছর ভারতে নির্বাসিত জীবন যাপনের পর দেশে ফিরে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম, কারাবরণ, হয়রানি ও হত্যাচেষ্টার শিকার হওয়ার পর শেখ হাসিনা প্রথম বার ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা বিচলিত হননি, তিনি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নিয়ে সাহসের সঙ্গে জনগণের ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জয়যুক্ত হন এবং একাত্তরে পরাজিত শক্তির নানামুখী ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে দেশ পরিচালনায় জনগণের রায় পান। তার সরকারকে উত্খাত করা কিংবা তিনি যাতে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করতে না পারেন, প্রভুদের নির্দেশে সেই চেষ্টা কম হয়নি। কিন্তু প্রচণ্ড সাহস, ধৈর্য, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অবিচল আস্থার কারণে শেখ হাসিনা সব ষড়যন্ত্র নস্যাত্ করতে সক্ষম হন। দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের গতি রুদ্ধ করে জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টির জন্য এসব ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা লক্ষ করি, তার দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামে পাকিস্তানি কারাগারে কেটেছে যৌবনের দীর্ঘ সময়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে শোষণ থেকে মুক্ত করে তাদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে তিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছেন, জনগণের প্রতি ছিল তার পূর্ণ আস্থা। তাই পর্যায়ক্রমে কৌশলগতভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা করেছেন, পাকিস্তানি শাসকদের অধীনে সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, যাতে পাকিস্তানি শাসকেরা তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতা হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে। বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশসমূহ ও নেতৃবর্গ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা নন, কিন্তু ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতা ঘোষণায় বাধ্য হয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার আগে ৭ মার্চ তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে তার ঐতিহাসিক ভাষণে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিভিন্ন দিক, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করা সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করার বিষয়টি অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশের দীর্ঘ কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের ডাক দেন।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ২১ মিনিটের মহাকাব্যিক ভাষণ তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষকে নতুনভাবে শুধু উজ্জীবিতই করেনি, পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করতে শপথ গ্রহণেও অনুপ্রাণিত করে। রেসকোর্স ময়দান থেকে নতুন উদ্দীপনায় জনগণ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করতে নিজ নিজ এলাকায় ছুটে যান। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বিশ্ব মানচিত্রে নতুন স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপাদমস্তক একজন খাঁটি বাঙালি। তাঁর শারীরিক গঠন, আচার-আচরণ, কথা বলার ধরন, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যগ্রহণ—সবই বাঙালি চরিত্রের সব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে। বলতে দ্বিধা নেই, তিনি একজন সাচ্চা জাতীয়তাবাদী বাঙালি নেতা, যিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে খ্যাত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বঙ্গবন্ধু আমাদের গর্ব ও সম্মানের, দেশে-বিদেশে আমাদের মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি।
বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ও প্রজ্ঞার যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা নানা ষড়যন্ত্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও বিশ্বে বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বাত্মক উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছেন। এ লক্ষ্যে তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী শেখ হাসিনার গতিশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কোটি কোটি বাঙালির মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে তাকে পৌঁছে দেবে। আমি মনে করি, শেখ হাসিনা বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কন্যা। তাই আমি তাকে ‘বঙ্গকন্যা’ নামে অভিহিত করে সম্মান জানাতে চাই। গত ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিনে আমি তাকে সেই অভিধায় ভূষিত করি, সেই দিনটি ছিল বিশ্ব কন্যা দিবস।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বে অর্থনৈতিক অগ্রগতি স্তব্ধ হয়ে গেছে, সাময়িকভাবে ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়ন। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বঙ্গকন্যা মানুষকে গভীর সংকটে পড়তে দেননি, পেশা-নির্বিশেষে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিটি কর্মহীন পরিবারকে রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। অর্থনীতির প্রতিটি খাতে প্রণোদনা দিয়েছেন, যাতে দেশের গতিশীলতা অক্ষুণ্ন থাকে। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এভাবে গোটা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছেন। শুধু কোভিড-১৯ নয়, বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ৩১ জেলায়। এসব জেলার মানুষ ব্যাপকভাবে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। তারা ঘরবাড়ি হারিয়েছে, কৃষিসম্পদের ক্ষতি হয়েছে, সড়ক ও কালভার্টসমূহ বিধ্বস্ত হয়েছে। বন্যাদুর্গত মানুষ জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, উঁচু ভবন ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সর্বশক্তিমানের কৃপায় একজনেরও ক্ষুধায় মৃত্যু হয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট সংকট যথাযথভাবে মোকাবিলা করার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। বিদেশি মুদ্রার মজুত (বর্তমানে ৪২ বিলিয়ন) এবং প্রবৃদ্ধির হার প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দেশের এগিয়ে থাকার পরিচয় বহন করে। এশিয়ায় অনেক দেশের পক্ষেই তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে সম্ভব হয়েছে বঙ্গকন্যার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণে।
কোভিড-১৯ মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনরাত অক্লান্তভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, সংকট নিরসনে দ্রুত সিদ্ধান্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনগুলো হচ্ছে খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। স্বাধীনতা অর্জনের পর এগুলো পূরণই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য। উত্তরাধিকার সূত্রে শেখ হাসিনার লক্ষ্যও তাই, মানুষের এই মৌলিক চাহিদা পূরণে তিনি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে তিনি গৃহহীন দরিদ্র মানুষের গৃহের ব্যবস্থা করতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। দরিদ্র মানুষের মধ্যে ১০ টাকা মূল্যে চাল বিতরণ করা হয়েছে। শিক্ষা খাতে ছাত্রছাত্রীদের উত্সাহিত করতে বিনা মূল্যে বই বিতরণ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা বিস্তৃত হয়েছে। আমাদের দরিদ্র জনগণ সস্তা দামে কাপড়চোপড় পাচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, জনগণের মৌলিক চাহিদার সবই পূরণ হচ্ছে।
সর্বশেষ পদ্মা সেতু বঙ্গকন্যার দৃঢ় প্রত্যয় ও মাথা নত না করার শ্রেষ্ঠ নজির। বিশ্বব্যাংক ভিত্তিহীন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গকন্যা মাথা নত করেননি। নিজস্ব অর্থায়নে আজ পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়েছে। ইস্পাতকঠিন আস্থা ও দৃঢ়তা ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। কর্ণফুলী টানেল আরেক দুঃসাহসের প্রতীক। এই টানেলের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। খুলে যাচ্ছে অর্থনৈতিক অগ্রগতির দরজা একের পর এক। ঢাকা মহানগরীতে মেট্রো চলবে—এ ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্নও আজ বাস্তবায়নের পথে। পালটে যাচ্ছে দেশের যোগাযোগব্যবস্থার চিত্র। বাংলাদেশের কোনো অংশই অবহেলিত থাকছে না। বাঙালির দুর্জয় সাহস বঙ্গকন্যার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে।