শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিরোনাম: স্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু আজ   স্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু আজ   স্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু আজ   ফিল্ম সিটি থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধুর’ নাম   সিলেটের সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াহিয়া গ্রেপ্তার   অনন্য অসাধারণ শেখ হাসিনা আমাদের গর্ব   নরসিংদীতে ‘থার্টি ফার্স্ট’ উপলক্ষে চাঁদা না দেয়ায় ব্যবসায়ীকে কোপালো সন্ত্রাসীরা   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
শিল্প-সাহিত্যের এক অক্ষয় নাম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন
সজিব তুষার
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ৬:২৩ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

যে কবি এবং শিল্পী সময়ের কথা সময় আসার দারুন আগে বলে দিয়ে গেছেন, ফুটিয়ে তুলেছেন রঙতুলি-স্টেনসিলে সে জীবিত অবস্থায় কতটা শিল্পী হয়ে বাঁচতে পারে জানা নেই। তবে ইতিহাস যে তার নাম প্রকৃতির রন্ধ্রে-রন্ধ্রে সাঁটিয়ে দিতে পারে তা অন্ততঃ বাঙালীকে আলাদা করে বুঝিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। বাংলা শিল্প-সাহিত্যে এমনই এক অক্ষয় নাম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। যার জীবনের অনুপ্রেরণা আজ হাজার-হাজার শিল্পীর বেঁচে থাকার এক মাত্র অবলম্বন।  

আজ ২৯ ডিসেম্বর। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৬তম জন্মবার্ষিকী এবং ১০৭তম জন্মদিন। ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কেন্দুয়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি চমৎকার আগ্রয় ও দারুণ অধ্যাবসায়ই তাকে আজকের বিখ্যাত চিত্রশিল্পীতে পরিণত করে। এর জন্য কম জ্বালাও তাকে পহাটে হয়নি। বয়স যখনমাত্র ষোল বছর ঠিক সেই বয়সেই বন্ধুদের সাথে ভারতের কলকাতায় গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য পালিয়ে গিয়েছিলেন। ঠিক সে সময়েই মাথায় চেপেছিল তথাকথিত শিক্ষা সিস্টেম থেকে বের না হতে পারলে প্রকৃতির শিল্পী হয়ে বেড়ে উঠতে পারবেন না তিনি। জয়নুল আবেদিনের আগ্রহ দেখে মা নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক (ম্যাট্রিক) পরীক্ষার আগেই স্কুলের পাঠ বিষর্জন দিয়ে কলকাতায় আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট এর রেজাল্ট হল। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন শিল্পী জয়নুল আবেদীন। সেই ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ এবং গৃহিনী মা জয়নাবুন্নেছা হয়তো তখনও আঁচ করতে পারেন নি এই পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফল ইত্যাদি আঁকিয়ে ছেলেটি বাঙলার রঙতুলির প্রাণ পুরুষ হয়ে উঠবে। 

‘শিল্পাচার্য’ অভিদা পাওয়া এই গুণী শিল্পীর শিল্পকর্মের হিসেব রাখাটা একটু ঝামেলারই বটে। তবে সব মিলিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংগৃহীত তার শিল্পকর্মের সংখ্যা ৮০৭টি। বেঙ্গল ফাউন্ডেশানের সংগ্রহে আরো প্রায় ৫০০ চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে। এখনো চার শতাধিক চিত্রকর্ম সংরক্ষিত রয়েছে তার পরিবারের কাছে। ৬২টি আছে ময়মনসিংহের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত চিত্রকর্ম। এছাড়াও পাকিস্তানের বিভিন্ন সংগ্রহশালায় তার বিপুল পরিমাণ চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে।


১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ ছাড়াও তার বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলো হল: ১৯৫৭-এ নৌকা, ১৯৫৯-এ সংগ্রাম, ১৯৭১-এ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ম্যাডোনা প্রভৃ‌তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।তারদীর্ঘ দুটি স্ক্রল ১৯৬৯-এ অঙ্কিত ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭৪-এ অঙ্কিত ‘মনপুরা-৭০’ জননন্দিত দুটি শিল্পকর্ম। তিনি চিত্রাঙ্কনের চেয়ে চিত্রশিক্ষা প্রসারের ওপর অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছেন। অনুমান করা হয় তার চিত্রকর্মের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি।

" align=

১৯৪৩ এর “মেডোনা-৪৩” ছবিটি নিয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, "আপনি দুর্ভিক্ষের উপর ছবি আঁকলেন অথচ বন্যার ছবি আঁকলেন না কেন?"

তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “বন্যা প্রাকৃতিক। তাই এর বিরুদ্ধে করবার কিছুই নেই, দুর্ভিক্ষ মানুষের সৃষ্টি। মানবতার অপমান আমাকে ব্যথিত করেছিল। তাই দুর্ভিক্ষের ছবি একেছি।”

উপমহাদেশে চিত্রশিল্পকর্মে বিশেষকরে বাংলাদেশে শিল্পী জয়নুল আবেদিনের অবদান অবিস্মরনীয়। যুবা বয়সেই তার উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট স্থাপিত হয়। জয়নুল আবেদিন ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষক।

" align=

একটি মজার ঘটনা ঘটে ১৯৫৩ সালে। শিল্পী জয়নুল আবেদিন ইউরোপ ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। স্প্যানিশ ভাষা না জানায় পড়লেন এক মহা মুসিবতে। তাই শিল্পী খাবার সময় রেস্তোরাঁয় ঢুকে তার স্কেচ খাতার সাদা কাগজে একপাশে একটি সিদ্ধ করার কড়াই এবং একটি ভাজি করার কড়াই আঁকলেন। তারপর একটি বড় গরু, পাশে গরুর পেছনের রান এঁকে তীর চিহ্ন দিয়ে সিদ্ধ করা কড়াইয়ের দিকে দেখালেন। অর্থাৎ, রানের মাংস রান্না খেতে চান।

একে একে মুরগির ডিম, কপি, আলু যা যা খাবার প্রয়োজন সব এঁকে ফেললেন। স্প্যানিশ ওয়েটারের আর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে শিল্পী কী খেতে চান। তারপর থেকে এভাবেই চলতে লাগলো ছবি এঁকে খাবার অর্ডার দেওয়ার তার এক নতুন পদ্ধতি ।

জয়নুল আবেদিন এরপর বিদেশে পথ চলতে আর খুব একটা অসুবিধেয় পড়েননি। কারণ সঙ্গে থাকতো তার স্কেচ খাতা আর পেন্সিল। যে কোন ভাষাভাষীর সঙ্গে ছবি এঁকে ভাবের আদান-প্রদান করে নিতেন, ছবির ভাষা দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতেন।( বই-শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, লেখকঃ হাশেম খান)

বিশ্বসাহিত্য ভবন এর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন স্মারকগ্রন্থে মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম এর একটি লেখা স্মৃতিচারণ থেকে পাওা যায় আরেকটি ঘটনা। সেখানে এভাবে উল্লেখ ছিলো, “জয়নুল আবেদিন ছেলেবেলায় বাঁশ ও বেতের কাজ, নকশিকাঁথা, জামদানি শাড়ির নকশা, কুমারপাড়া ইত্যাদি দেখতে পছন্দ করতেন। এসব দেখে নিজে নিজেই ছবি আঁকতেন। তখনকার সময় ক্লাস নাইন-টেনে র্যােপিড বই ছিল। পড়াশোনার ফাঁকে র্যাইপিড বইয়ের পাতার চারপাশে তিনি ছবি আঁকতেন।

স্কুলের পড়াশোনা তার ভালো লাগত না। ক্লাসে বসে জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কখনো প্রকৃতি দেখতেন। একদিন জয়নুল আবেদিন নিবিষ্ট মনে বইতে ছবি আঁকছেন দেখে হেড মাস্টার তার বইটি চেয়ে নিলেন। তার বই এক নজর বুলিয়ে বললেন- ‘বইটি আমার কাছে থাকুক।’
এদিকে জয়নুল বেশ বিব্রত হলেন। ভয়ে স্কুল পালালেন। কদিন যেতেই হেড মাস্টার বাড়িতে খবর নিয়ে জানতে পারলেন- জয়নুল স্কুলের উদ্দেশে বের হয় এবং যথাসময়ে বাড়ি ফিরে আসে। পরে হেড মাস্টার নিজেই তাদের বাড়িতে এলেন। তার বাবাকে বললেন- ‘আপনার ছেলে তো স্কুলে যায় না। তার কি কোনো অসুখ করেছে?’
জয়নুলকে ডাকা হলো। তিনি শিক্ষকের সামনে এসে বললেন- ‘ভয়ে স্কুলে যাই না।’
‘কীসের ভয়?’
আবেদিন বললেন- ‘বইতে ছবি এঁকেছি এই ভয়ে।’

তখন হেড মাস্টার হো হো করে হাসলেন। তিনি বললেন- ‘তুমি ছবি এঁকে পালাচ্ছ, আর আমি ওই ছবি দেখে তোমাকে খুঁজছি। আমি তোমার বাবার সামনে বলে যাচ্ছি, তুমি চমৎকার ছবি আঁকো। তুমি যদি ছবি আঁকার জগতে যাও তাহলে খুব ভালো করবে।’

তখন জয়নুল আবেদিনের ভেতর একটি স্বপ্ন তৈরি হয়।”

জয়নুল আবেদীনের জন্মদিনে বর্তমান যুগের একজন স্বাধীন শিল্পী রাজিব মাহবুব। যিনি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় পড়াশোনা করেছেন। তাদের জীবনে জয়নুল আবেদীনের অনুপ্রেরনা সম্পর্কে ভোরের পাতার এক প্রশ্নে তিনি বলে, জয়নুল আবেদীনের “মেডোনা-৪৩” আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করে। দুর্বিক্ষে একজন মা ও শিশুকে দিয়ে দুর্বিক্ষগ্রাসী অবস্থাকে ফুটিয়ে তোলা আসলেই যুগান্তকারী একটা কাজ। আমরা স্বাধীন শিল্পীরা বরাবরই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ।”

বাংলাদেশের বর্তমান শিল্পচর্চা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “ আমরাতো মৌলিক শিল্পটাই ধরে রাখতে চাই। কিন্তু যখন শিল্প সামগ্রী কেনার জন্য ইচ্ছার বিরুদ্ধে এর ওর ছবি এঁকে টাকা সংগ্রহ করতে হয়। তখন মনে হয় শিল্পচর্চাটা অভিশাপ। অথচ ভাগ্যের কি নির্মন পরিহাস শত কষ্ট হলেও একে(শিল্পকে) আঁকড়ে ধরে রাখার মাঝেই আনন্দ পাই। রাষ্ট্র থেকে যদি আমাদের শিল্পীদের জন্য কোন ব্যবস্থা করা হত বাংলাদেশের অসঙ্খ গুণী শিল্পীরা সহজেই বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো।”

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বেড়ে উঠেছিলেন ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলার) ব্রহ্মপুত্র নদের প্লাবন অববাহিকার শান্ত-সুনিবিড় মনোরম কেন্দুয়ায় গ্রামে।তাঁর বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের দারোগা। মা জয়নাবুন্নেছা ছিলেন গৃহিণী। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়। পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবারের কাছ থেকেই। তাঁর শৈল্পিক মনন নির্মাণে প্রকৃতির প্রভাব ছিল অসামান্য ও সুদূরপ্রসারী। প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি পেয়েও তিনি নিজেকে প্রকৃতির ছাত্র পরিচয় দিতে বেশি ভালোবাসতেন। স্পষ্ট ভাষায় বলতেন, “নদীই আমার শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক”। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলার প্রকৃতি, জীবনাচার, প্রাচুর্য, দারিদ্র্য এবং বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহা তাঁর তুলি আর ক্যানভাসে মূর্ত করে তুলেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ৬১ বছর বয়সে দীর্ঘ ছয় মাস ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগে মৃত্যুবরণ করেন বাঙলা ও বাঙালীর প্রাণপুরুষ শিল্পযোদ্ধা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
https://www.dailyvorerpata.com/ad/BHousing_Investment_Press_6colX6in20200324140555 (1).jpg
https://www.dailyvorerpata.com/ad/last (2).gif
https://www.dailyvorerpata.com/ad/431205536-ezgif.com-optimize.gif
https://www.dailyvorerpata.com/ad/agrani.gif
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]